সম্পাদকীয়

ভারতের সম্পদ-বৈষম্য ও পুঁজিবাদের অমানবিক রূপ

এই বৈষম্যের পরিণতি সুদূরপ্রসারী। অর্থনীতির চাবিকাঠি আজ ওই ১০ শতাংশ ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত।

প্রভাত কুমার মিত্র (বিশিষ্ট সমাজকর্মী): ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। প্রযুক্তি, শিল্প, পরিষেবা সব ক্ষেত্রেই ভারত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অগ্রগতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক গভীর বৈষম্যের ছবি। দেশের মোট সম্পদের একটি বিশাল অংশ এখন কেবলমাত্র অল্প কয়েকটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের শীর্ষ ১০ ধনী পরিবার দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর শীর্ষ ১০ শতাংশ পরিবারের হাতে রয়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশ সম্পদ। অর্থাৎ, ভারতের ৯০ শতাংশ জনগণ ভাগাভাগি করছে বাকি সামান্য সম্পদ-যা প্রকৃত অর্থে এক অর্থনৈতিক বৈষম্যের নির্মম উদাহরণ।

এই বৈষম্যের পরিণতি সুদূরপ্রসারী। অর্থনীতির চাবিকাঠি আজ ওই ১০ শতাংশ ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত। তারা যা চাইবে, বাজার সেই দিকেই ঘুরবে। তাদের পছন্দই নির্ধারণ করছে কোন খাতে বিনিয়োগ হবে, কোন খাতে গবেষণা বা উন্নয়ন ঘটবে। ফলে দেশজুড়ে বিনিয়োগ হচ্ছে বিলাসবহুল খাতে প্রসাধন সামগ্রী, ফ্যাশন, পোশাক, গাড়ি, প্রযুক্তি ও লাক্সারি পণ্যতে। অন্যদিকে, দরিদ্র জনগণের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা মৌলিক চাহিদার খাতে তেমন বিনিয়োগ দেখা যায় না। অর্থনীতি যেন ধনীদের সুখের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

এই বৈষম্যের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হল মুকেশ আম্বানির ছেলে অনন্ত আম্বানির বিয়ে। বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, এই বিয়ের মোট খরচ ছিল প্রায় ১,১০০ থেকে ১,৩০০ কোটি টাকা। শুধুমাত্র প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানের ব্যয়ই ছিল প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক তারকাদের উপস্থিতি, বিলাসবহুল আতিথ্য, শিল্পী ও সেলিব্রিটিদের পারফম্যান্স– সব মিলিয়ে এটি এক ‘রাজকীয় আয়োজন’ হিসেবে বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়েছিল। এমন এক দেশে, যেখানে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন অর্ধেক পেট খেয়ে ঘুমোয়, সেখানে এক পরিবারের বিবাহে হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়া নিঃসন্দেহে এক অমানবিক বৈপরীত্য।

এই অবস্থার জন্য শুধু ধনীদের লোভ বা বিলাসপ্রিয়তাকেই দায়ী করা যায় না। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নীতিও অনেকাংশে এই বৈষম্যকে পুষ্ট করছে। কর-নীতি, ভর্তুকি, বিনিয়োগ-নীতিতে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা অনেক সময় নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলে। ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যায়, আর ধনীরা আরও ধনী হয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্য কেবল অর্থনীতির সমস্যা নয়, এটি একটি নৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট। যখন একটি সমাজে ধনসম্পদের এত বড় অংশ অল্প কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নড়ে যায়। ধনীরা শুধু অর্থনীতির নয়, রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণেরও নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। জনগণের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায় তাদের বিলাসের কলরোলে।

তবে এই বাস্তবতা পরিবর্তন করা অসম্ভব নয়। প্রয়োজন সুশাসন, ন্যায্য করব্যবস্থা, সম্পদ পুনর্বণ্টনের কার্যকর নীতি, এবং সামাজিক সচেতনতা। সরকার যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও কষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ায়, তবে সমাজে ধনসম্পদের স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ায়, তবে সমাজে ধনসম্পদের ভারসাম্য কিছুটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

শেষ কথা হল, ভারত আজ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও, সেই শক্তির মূলভিত্তি ন্যায় ও সমতা না হলে উন্নয়নের দাবিটি শূন্য হবে। যতদিন পর্যন্ত দেশের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটাবে, ততদিন পর্যন্ত এক পরিবারের ১,০০০ কোটির বিয়ে শুধু বিলাস নয়, এক নীরব বিদ্রূপ হিসেবেই থেকে যাবে।

নির্বাচনী বন্ড— গণতন্ত্রের মুখে মুখোশ

গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি পবিত্র প্রক্রিয়া। জনগণের ইচ্ছাই সরকারের ভিত্তি গঠন করে। কিন্তু যখন অর্থ ও ক্ষমতার দখলে এই ইচ্ছাশক্তি বিকৃত হয়, তখন গণতন্ত্র কেবল কাগজে কলমে বেঁচে থাকে। ভারতের প্রেক্ষাপটে এই বিকৃতি এক নতুন রূপ পেয়েছিল নির্বাচনী বন্ড নামে একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার ‘স্বচ্ছতা’র নামে প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু বাস্তবে তা রাজনৈতিক অর্থনীতিকে আরও অস্বচ্ছ করে তুলেছিল।

নির্বাচনী বন্ড কী?

নির্বাচনী বন্ড হল এক ধরনের আর্থিক উপকরণ, যা ২০১৮ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চালু করে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-এর মাধ্যমে যে কেউ এই বন্ড কিনতে পারত এবং তা যে কোনও রাজনৈতিক দলকে দান করতে পারত। সরকারের দাবি ছিল এই ব্যবস্থায় দাতার নাম ব্যাঙ্কের কাছে গোপন থাকবে, ফলে কালো টাকার ব্যবহার কমবে এবং রাজনৈতিক অনুদান আরও ‘স্বচ্ছ’ হবে। কিন্তু বাস্তবে হল উল্টো। সাধারণ মানুষ, এমনকী নির্বাচন কমিশনও জানতে পারল না কে কোন দলকে কত টাকা দিচ্ছে। শুধু সরকার, যার হাতে ব্যাঙ্ক ও গোয়েন্দা সংস্থা- তারাই জানত কারা কাকে টাকা দিচ্ছে।

গোপনীয়তার আড়ালে দুর্নীতি

নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থার মূল সমস্যাটি হল এর অস্বচ্ছতা। জনগণ জানতে পারল না কোন শিল্পপতি বা কর্পোরেট গোষ্ঠী কোন রাজনৈতিক দলকে কত অনুদান দিল। এতে কর্পোরেট ও সরকারের মধ্যে গোপন আঁতাত আরও দৃঢ় হল। যে সব কোম্পানি সরকারের অনুগ্রহ চায়, তারা সহজেই বিপুল অর্থ দান করে সরকারি সুবিধা পাওয়ার রাস্তা খুলে নিল। ফলে এটি গণতন্ত্রকে ‘জনগণের সরকার’ থেকে সরিয়ে ‘পুঁজিপতিদের সরকার’ বানানোর এক চতুর কৌশল হয়ে দাঁড়ায়।

সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সত্যের উন্মোচন

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পটিকে অসংবিধানিক ঘোষণা করে। আদালত জানায়, জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। পরবর্তীতে যখন বন্ডের তথ্য প্রকাশিত হয়, দেখা যায় সর্বাধিক অনুদান কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির দিকেই গেছে। অনেক কোম্পানি অনুদান দেওয়ার পরই সরকার থেকে চুক্তি, প্রকল্প বা সুবিধা পেয়েছে।

গণতন্ত্রের বিপরীতে পুঁজির প্রভাব

নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনীতি আরও বেশি করে অর্থনির্ভর হয়ে উঠেছিল। ছোট বা বিরোধী দলগুলোর পক্ষে বড় কর্পোরেট অনুদান পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ফলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বৈষম্য বেড়েছে, আর নীতিনির্ধারণে জনগণের স্বার্থের জায়গা দখল করেছে কর্পোরেট লবি।

যখন সরকারই মাফিয়া হয়ে ওঠে পাড়ার মস্তান বা শহুরে মাফিয়া– আমরা সবাই এই চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত। তারা দোকানদার বা ব্যবসায়ীকে বলে, ‘আমরা তোমাকে সুরক্ষা দেব, বিনিময়ে মাসে একবার আমাদের ‘প্রিমিয়াম’ দিতে হবে। সেই অর্থই তোলা, আর এই অঘোষিত ‘ইন্সিওরেন্স’ই তাদের ব্যবসার ভিত্তি। কেউ না দিলে, দোকান ভাঙচুর হয়, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এই চাঁদাবাজি আমাদের চোখে যতটা ঘৃণ্য, রাষ্ট্র যখন একই কায়দায় নিজের নাগরিকদের থেকে অর্থ আদায় করে, অথচ তাদের মৌলিক সুরক্ষাও দিতে ব্যর্থ হয়– তখন সেটি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্রীয় তোলাবাজি আজ নানারূপে ছড়িয়ে পড়েছে। করের নামে, সারচার্জের নামে, সার্ভিস ফির নামে, কিংবা সরকারি প্রকল্পের নামে– নাগরিকের ঘামে উপার্জিত অর্থ থেকে ক্রমাগত কেটে নেওয়া হচ্ছে মাসিক প্রিমিয়াম। কিন্তু এই প্রিমিয়াম বা করের বিনিময়ে নাগরিক কী পাচ্ছে? রাস্তা ভাঙা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত, শিক্ষাক্ষেত্র বেসরকারিকরণের পেটে ঢুকে পড়েছে, কৃষক আত্মহত্যা করছে, কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন শ্রেণি, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, কর্পোরেট গোষ্ঠী-এরা সবাই এই চক্রের অংশ হয়ে বিলাসিতার চূড়ায় অবস্থান করছে।

পাড়ার মস্তানদের বিরুদ্ধে যখন এনকাউন্টার হয়, জনতা হাততালি দেয়। কিন্তু একই ধরনের চাঁদাবাজি যখন সরকার চালায়, তখন মানুষ তাকে ‘উন্নয়ন’ বলে মান্যতা দেয়, পতাকা ওড়ায়, স্লোগান তোলে। কারণ রাষ্ট্রের এই তোলাবাজি আইনের ছত্রছায়ায় চলে– তাই তা বৈধ মনে হয়। কিন্তু বৈধতা মানেই ন্যায্যতা নয়।

ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরও এক ভয়ঙ্কর মিল পাওয়া যায়– সব দলই এই ব্যবস্থার অংশ। ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী– তত্ত্বে যাই থাক, অর্থে ও অর্থনীতিতে তারা একাকার। দলগুলির অর্থসংগ্রহ, নির্বাচনী তহবিল, কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা– সব কিছুতেই একই রকম অস্বচ্ছতা। তাই এই রাষ্ট্রীয় তোলাবাজি নিয়ে কোনও দল সভা করে না, কোনও মিছিল হয় না, কোনও দলিল প্রকাশিত হয় না। কারণ লাল, নীল, সবুজ- রঙ ভিন্ন হলেও লোভের রঙ একটাই।

এবং এই লোভই আজ মস্তিষ্কহীন জনতার চিন্তাশক্তি কেড়ে নিয়েছে। মানুষ আজ ক্ষুদ্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার– এক দোকানদার বেশি দাম নিলেই প্রতিবাদ করে, কিন্তু সরকার তার ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দিচ্ছে, তবুও চুপ থাকে। কারণ রাষ্ট্র তাদের বুদ্ধিকে ‘দেশপ্রেম’, ‘ধর্ম’, ‘জাতীয় গর্ব’-এর রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। তাই তারা প্রতারিত হয়েও গর্ব অনুভব করে, শোষিত হয়েও আত্মতৃপ্ত থাকে।

আজ প্রয়োজন মস্তিষ্ক ফিরিয়ে আনার, প্রশ্ন করার। যদি পাড়ার মস্তান চাঁদা তোলে, তাকে অপরাধী বলা হয়—তা হলে যখন রাষ্ট্রই একই কায়দায় তোলাবাজি করে, তখন তাকে কেন দেবত্ব দিই? রাষ্ট্র যখন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ‘সুরক্ষা’-র নামে তোলা নেয়, তখন তা কেবল কর নয়, তা শোষণের এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ-তোলাবাজির রাষ্ট্রায়ন।

‘নির্বাচনী বন্ড’ ব্যবস্থাটি প্রমাণ করে যে, স্বচ্ছতার মোড়কে অস্বচ্ছতা লুকিয়ে রাখা যায় না। এটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকে আঘাত করেছে– যেখানে জনগণই আসল নিয়ন্ত্রক। সরকারের উচিত ছিল এমন একটি ব্যবস্থা করা, যাতে জনগণ স্পষ্টভাবে জানতে পারে রাজনীতিতে কার টাকা প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তা হল ধনীদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়– যেখানে তারা অর্থ ঢালতে পারে, কিন্তু তাদের মুখোশ খুলে যায় না। গণতন্ত্র টিকে থাকে জবাবদিহিতার উপর; গোপন দানের রাজনীতি সেই ভিত্তিকেই ধ্বংস করে। নির্বাচনী বন্ড তাই কেবল একটি অর্থনৈতিক নীতি নয় এটি ছিল অগণতান্ত্রিক শক্তির এক সুনিপুণ মুখোশ।

Related Articles