পরীক্ষা মানে কি শুধু প্রশ্নপত্র? নাকি এ এক মানসিক যুদ্ধ
আমি একটাই কথা বলি 'তুমি যতটা ভাবছো, তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম।'
ভোলানাথ দাস (শিক্ষক): পরীক্ষা মানে শুধু প্রশ্নপত্র নয়, এক মানসিক যুদ্ধ। এখানে জেতে সে-ই, যে নিজের ভয়কে জয় করতে পারে। প্রতিটি বছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার আগে উদ্বেগে ভোগে। কেউ ভাবে, ‘আমি পারব না।’ কেউ ভাবে, ‘আমার আর সময় নেই।’ কিন্তু আমি একটাই কথা বলি ‘তুমি যতটা ভাবছো, তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম।’
পড়া নয়, পড়ার রিদম গড়ে তোলো
ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই খুলে বসলে পড়া হবে। এটাই ভুল। মানব মস্তিষ্ক সর্বাধিক মনোযোগ ধরে রাখতে পারে ২৫–৩০ মিনিট।
তাই ‘পোমোডোরো পদ্ধতি’ ব্যবহার করো। প্রতি ৩০ মিনিট পড়ো, ৫ মিনিট বিরতি নাও। এই ছোট বিরতি মনকে রিফ্রেশ করে, স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। অন্যদিকে, ‘লাস্ট নাইট স্টাডি’ নামের মিথ এখনও অনেকের মধ্যে চালু। কিন্তু ঘুম-বঞ্চিত মস্তিষ্ক কখনও সম্পূর্ণ তথ্য ধরে রাখতে পারে না। রাতের জেগে পড়া নয়, ভোরের সতেজতা ব্যবহার করো।
ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে বড় ভুল
আমি বহু বছর ধরে ইংরেজি পড়াই। সবচেয়ে বড় ভুল দেখি ছাত্ররা ইংরেজিকে মুখস্থ করার বিষয় ভাবে।
তারা ভাবে, ‘আমি গ্রামার জানলে ইংরেজি শিখে ফেলব।’ কিন্তু বাস্তবতা অন্য। ইংরেজি শেখা মানে চিন্তাভাবনাকে অনুবাদ করা, শব্দ মুখস্থ নয়। তাই প্রতিদিন ৫ মিনিট নিজের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলো।
একটা ডায়েরি লেখো। আজ কী করেছো, আগামীকাল কী করবে। এই অভ্যাস মনের মধ্যে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্স’ তৈরি করবে। এটা বই নয়, মন দিয়ে শেখার পাঠ।
অভিভাবক ও শিক্ষক— অজান্তে করা কিছু ভুল
পরীক্ষার আগে অনেক অভিভাবক সন্তানকে বলেন, ‘ভালো না করলে সমাজ কী বলবে!’ এই বাক্যটাই শিক্ষার শত্রু। কারণ ছাত্র তখন জ্ঞান নয়, ভয় শেখে। ভয় থেকে কোনওদিন আত্মবিশ্বাস জন্মায় না। শিক্ষক হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব। নম্বর নয়, মনোবল শেখানো। ছাত্রকে বোঝাতে হবে ভুল করা অপরাধ নয়, ভুল থেকে শেখাই সাফল্যের শুরু।
অধ্যবসায়ের পাশাপাশি আত্ম-পর্যালোচনা দরকার
বেশিরভাগ ছাত্র কেবল কতক্ষণ পড়ছে সেটাই হিসেব রাখে, কিন্তু কীভাবে পড়ছে, তা কখনও ভাবে না।
এইখানেই সাফল্য ও ব্যর্থতার পার্থক্য। প্রতিদিনের শেষে নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করো
১️ আজ নতুন কী শিখলাম? ২️ কোথায় আটকে গিয়েছি? ৩️ আগামীকাল কীভাবে ভালো করব? এই ‘সেল্ফ রিভিউ’ পদ্ধতি যদি তৈরি করো, তা হলে শিক্ষক বা কোচ ছাড়াই নিজের উন্নতি মাপতে পারবে।
ডিজিটাল বিভ্রান্তি— প্রযুক্তি হোক সহায়, বাধা নয়
আজকের ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন লেকচার, ইউটিউব ভিডিও সব দেখে। কিন্তু তথ্যের অতিরিক্ততা তাদের মনোযোগ নষ্ট করে। তাই আমি বলি ‘লার্ন ওয়ান, অ্যাপ্লাই টু’। অর্থাৎ, একটি জিনিস শিখলে, সেটি দুইবার ব্যবহার করো। লিখে বা বলার মাধ্যমে। তা হলেই শেখাটা স্থায়ী হবে।
একজন সাধারণ ছাত্রও পারে অসাধারণ হতে। সফল ছাত্ররা জন্মগত মেধাবী নয় তারা শৃঙ্খলাবদ্ধ। যে ছাত্র প্রতিদিন ২ ঘণ্টা মনোযোগ দিয়ে পড়ে, সে সেই ছাত্রের চেয়ে এগিয়ে, যে একদিনে ১০ ঘণ্টা বই খোলে কিন্তু মনোযোগ রাখতে পারে না। অনেকে ভাবে, ৮০ শতাংশ পাওয়া ছাত্ররাই জীবনে এগোয়। কিন্তু ইতিহাস বলে গড় নম্বর পাওয়া ছেলেমেয়েরাই অনেক সময় জীবনের মাঠে জিতে যায়। কারণ তারা হারে না, শেখে। শিক্ষার লক্ষ্য— শুধু পাস নয়, মানুষ হওয়া। আমি আমার ছাত্রদের বলি, ‘মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা জীবন নয়, এটা কেবল দরজা খোলা।’
ভাল ফলাফলের সঙ্গে ভাল আচরণও জরুরি।
যে নম্র, শৃঙ্খলিত ও মানবিক, সে যে কোনও মঞ্চে নিজের জায়গা করে নেয়। আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স বা ইকিউ-র গুরুত্ব বাড়ছে। যে ছাত্র নিজের রাগ, ভয় ও ব্যর্থতা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, সে শুধু ভালো ছাত্র নয়, ভবিষ্যতের নেতা হয়ে ওঠে। পরীক্ষা একদিন শেষ হবে। ফলাফল কাগজে আসবে, কিন্তু তোমার শেখা, আত্মবিশ্বাস ও চরিত্র সারাজীবন থাকবে। তাই এখনই শুরু করো। পড়ো মন দিয়ে, সময়কে সম্মান করো, প্রশ্ন করতে লজ্জা পেয়ো না, আর ভুলকে শিক্ষক মনে করো। একজন ভালো ছাত্র মানে কেবল মেধাবী নয়, সে ধৈর্যশীল, শৃঙ্খলিত, কৃতজ্ঞ এবং সচেতন মানুষ।


