রাজ্যের খবর

দেড়শো বছরের প্রাচীন চাকদহের গঙ্গামাতার মন্দির, শিবরাত্রি ঘিরে আজও সেই উন্মাদনা

The 150-year-old Gangamata Temple in Chakdaha still has the same fervor surrounding Shivaratri

Truth Of Bengal: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়, নদিয়া: আজ শিবরাত্রি। নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন কালীগঞ্জের গঙ্গা মাতার মন্দির গমগম করবে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবেন এখানকার শিব মন্দিরে পুজো দিতে। এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনী। দেড়শ বছর আগে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা। তখন গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল এই মন্দিরের গা ঘেঁষে। মন্দিরের গর্ভ গৃহ থেকে সরাসরি গঙ্গায় স্নান করতে নামার ঘাট ছিল। সময়ের প্রবাহমান ধারায় তা আজ হারিয়ে গিয়েছে। গঙ্গা দূরে সরে গিয়েছে অনেক অনেক দূরে। তবে আজও যেন তার ছিহ্ণ রয়ে গিয়েছে এখানে। সেই আমলে শিবরাত্রি উপলক্ষে যে জমজমাট ছবিটা ধরা পড়তো আজও তা অবিলকল রয়েছে। পুণ্যার্থীদের ভীড়ে আজ অন্য মাত্রা পাবে গঙ্গা মাতার মন্দির।

আজ থেকে আনুমানিক প্রায় দেড়শো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নদিয়ার চাকদহের কালীগঞ্জে গঙ্গা নদীর তীরে গঙ্গা মাতার মন্দির। তখন গঙ্গা বইতো কুল কুল করে। এই গঙ্গা মন্দিরের পাশ দিয়েই সুখ-সাগর রোড। পুরাণ মতে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীহট্টে দীক্ষা নেওয়ার পর এই রাস্তা ধরেই নীলাচলের পথে যাত্রা করেছিলেন। এই পথ ধরে যাওয়ার সময় চাকদহের চাঁদুড়িয়ায় তিনি বিশ্রাম নেন। আবার দীক্ষা নেওয়ার জন্য এই পথ ধরে তিনি শ্রীহট্টে গিয়েছিলেন বলেও কথিত আছে। সেই সময় কালীগঞ্জ ছিল বড় নদীবন্দর। এই কালীগঞ্জ থেকে নৌকা পথে কুলেরপাট হয়ে শ্রীহট্টতে গিয়েছিলেন দীক্ষা নেওয়ারর জন্য। মাধবেন্দ্রপুরীর ভাইপো ঈশ্বরী পুরীর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন।

দেড়শো বছর আগে এই কালীগঞ্জে গঙ্গাদেবীর আশ্রম ও পরবর্তীতে ১৩০৫ সালে গুরু নানক সম্প্রদায়ের শিষ‍্য ও সেবাইত নানক স্মরণ উদাসী তিনি মন্দির স্থাপন করেন। সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রা শুরু করেন। এই মন্দির সেইরকমই অবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন করেন সেবাদাস উদাসী। বর্তমানে গঙ্গা কালীগঞ্জ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে সরে গেছে। তবে পুরনো গতিপথের চিহ্নটা আজও রয়ে গেছে এখানে। নদীর চড়ে তৈরি হয়েছে শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম ও অন্যান্য গ্রাম। কিন্তু এই মন্দিরের মাহাত্ম্য আজও কমেনি। রয়েছে গঙ্গা মাতার মন্দির, গুরুজিহ এবং দুর্গা মন্দির এবং বারোটি শিবলিঙ্গ অবস্থিত। অবস্থিত সমাধিস্থল।

শিবরাত্রিতে উৎসব শুরু হয় এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় মানুষ ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন এখানে। সারাদিন উপোস করার পর মেয়েরা শিবের মাথায় জল ঢালতে ভিড় জমান। শিবের পুজো ঘিরে এক অন্যরকম মাত্রা যোগ হয় এখানে। বর্তমানে মন্দিরের মহারাজ সেবায়েত নানক চরণ উদাসী। মহারাজ জানান, গঙ্গা এখন অনেক দূরে সরে গেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের ভেতর থেকেই সরাসরি তখন গঙ্গায় পৌঁছনো যেত। সেই সময় গুরু মহারাজ গঙ্গাস্নান করতেন গর্ভগৃহের মধ‍্য দিয়ে গিয়ে।

সোজা গঙ্গায় স্নান করতেন তিনি। তাঁর নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে রয়ে। তাঁর সমাধি এখন কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। এই মন্দির ঘিরে ছিল ১২ টি শিব মন্দির। সেই সময় থেকেই শিবের পুজো হতো। এখনও শিবরাত্রি সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষ ভিড় জমান। মা-বোনেরা আসেন পুজো দেন্ আজ শিবরাত্রি উপলক্ষে মা বোনেরা শিবের মাথায় জল ঢালতে আসবেন। গঙ্গা দূরে সরে গেছে কিন্তু তার স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে নানক চরণদাসী মহারাজ। বিশেষ করে মন্দিরের গর্ভ গৃহ থেকে যে পথ গঙ্গায় চলে গিয়েছিল তা যেন সেই পুরনো স্মৃতিকে আজও বহন করে চলে।

নদীয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন এলাকা এই কালীগঞ্জ। এই এলাকা ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে ইংরেজ আমল, কালীগঞ্জের নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানান কাহিনী। নদীয়ার অন্যতম প্রাচীন বন্দর থেকে শুরু করে গঞ্জ এলাকা ছিল এটি। সাপ্তাহিক হাট বসতো এখানে। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ হাটে আসতেন। গরুর গাড়িতে মাল ভর্তি করে আবার ফিরে যেতেন যে যে যার এলাকায়। নদীপথে দূর দূরান্ত থেকে ছোট ছোট জাহাজ এখানে এসে পৌঁছাতো। জাহাজ থেকে মাল খালা শর পর তা গরুর গাড়িতে তুলে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া চলতো। সকাল দুপুর বিকেল গমগম করতো সাধারন মানুষের ব্যস্ততায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল বা ইছামতী উপন্যাসে অনেক কাহিনী বর্ণিত রয়েছে এই কালীগঞ্জের।

Related Articles