দেশরাজ্যের খবর

বাংলার ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ পদ্ধতিকেই মডেল মানল কেন্দ্র

Conservation of Mangroves

The Truth of Bengal, Mou Basu: মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখলের কথা, “হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া থিঙ্কস টুমরো।” অর্থাৎ, বাংলা আজ যা ভাবে, দেশ ভাবে আগামীকাল। এই আপ্তবাক্যটি আরো একবার সত্যিই হয়ে উঠেছে। বাংলার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে বাঁচাতে রাজ্য সরকার যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে তাকেই এবার গোটা দেশের জন্য মডেল করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। আসলে ২০২০ সালে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত হানে রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকার উপকূলবর্তী এলাকায় ম্যানগ্রোভ লাগানোর কর্মসূচি নেয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল একসময় সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় বিঘার পর বিঘা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কেটে সাফ করে সেখানে মেছো ভেড়ি তৈরি করেছিল একদল সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি। কিন্তু সাধারণ মানুষের সদিচ্ছায় আর পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতায় ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের কাজ রোখা সম্ভব হয়। সুন্দরবনকে বাঁচাতে দরকার ম্যানগ্রোভের। ম্যানগ্রোভ না থাকলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে বাদাবন। বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়েছে সুন্দরবনে। বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজে ধ্বংস হয়েও সুন্দরবনবাসীকে রক্ষা করেছে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। তাই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে রাজ্যের বন দফতরও।

আম্ফানের পর লাখ লাখ ম্যানগ্রোভ চারা পোঁতা হয় সুন্দরবনের পাশাপাশি রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকায়। রাজ্যের বন দফতর সূত্রে খবর, গত বছর রাজ্যে প্রায় ১৫ কোটি ম্যানগ্রোভ চারা পোঁতা হয়েছে। গত জুলাই মাসেও বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবসেও কয়েক হাজার ম্যানগ্রোভ চারা বসানো হয়েছে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। আগামী এক বছরে এক কোটি ম্যানগ্রোভ চারা বসানোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের এই ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের উদ্যোগকেই এবার মডেল করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের বিভিন্ন উপকূলবর্তী এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে রক্ষা করা ও ইকো-ট্যুরিজম চালু করে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার্জনের সুযোগ করে দিতে কেন্দ্র চালু করেছে “Mangrove Initiative for Shoreline Habitats and Tangible Incomes” বা MISHTI প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এরমধ্যেই রাজ্য সরকারের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব এসেছে যে তারা গোটা দেশের জন্যই বাংলার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষার কর্মসূচিকে মডেল করতে চায়।

২০১৮ সালে Wetlands International and The Nature Conservancy শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসকে ঠেকিয়ে মাটির ক্ষয় আটকাতে পারে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। তার হাতে গরম উদাহরণ দেখা গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঝড়খালিতে। মাতলা, বিদ্যাধরী আর হেরোভাঙা নদী ঘেরা ঝড়খালি অত্যন্তই সাইক্লোনপ্রবণ এলাকা। আয়লা, ফণি, বুলবুল আর আম্ফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াল রূপ চাক্ষুষ করেছে ঝড়খালিবাসী। কিন্তু ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থাকার কারণে ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের হাত থেকে রক্ষা পায় ঝড়খালি। ২০০৫ সাল থেকে ঝড়খালিতে ম্যানগ্রোভের চারা বসানোর কাজ করে চলেছে “ঝড়খালি সবুজ বাহিনী” নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ২০১৭ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ম্যানগ্রোভ চারা বসানো হয়েছে।

৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে বসবে জি২০ সম্মেলন। সেই বৈঠকের আগে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিকদের একটি দল এরমধ্যে রাজ্যে এসে ম্যানগ্রোভ বসানোর কর্মসূচি পরিদর্শন করে গেছে। রাজ্যের বন দফতর সূত্রে খবর, বাংলায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষা করতে সরকারের তরফে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা দেখে খুব খুশি জি-২০ দলের সদস্যরা। রাজ্যের ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর কর্মসূচির বিষয় কেন্দ্রের আধিকারিকরা খুঁটিনাটি খোঁজ নিয়েছেন। রাজ্যের বন দফতরের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিকদের জানানো হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরপরই স্থির হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে রাজ্যের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল রক্ষা করার কর্মসূচিকে মডেল করতে চেয়ে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি প্রস্তাবে রাজি হন তবে রাজ্যের বন দফতর নয়া কর্মসূচি নিয়ে এগোবে। উপকূলবর্তী এলাকায় মাটির ক্ষয় নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করতে বিশেষজ্ঞদের পাঠাবে বন দফতর। রিপোর্টের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদি সত্যিই বাংলাকে মডেল করা হয় গোটা দেশে তা’হলে তা রাজ্য সরকারের বন দফতরের কাছে বিশাল স্বীকৃতি হবে।

গোটা দেশের মধ্যে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৪০%-ই রয়েছে বাংলায়। ম্যানগ্রোভ রক্ষায় “ম্যানগ্রোভ সেল” গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। ম্যানগ্রোভের চারা পোঁতার পাশাপাশি তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করার জন্যই এই “ম্যানগ্রোভ সেল” গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের বন দফতর ২০২০-২০২১ সালে ১০,৩৯৮ একর জমিতে ১৫.৫৬ কোটি ম্যানগ্রোভ চারা বসিয়েছে। গাছ বসানো হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা সদস্যদের মাধ্যমে। এর জন্য খরচ হয়েছে মোট ৮০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১০০ দিনের প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা।

Related Articles