বিলুপ্তির পথে নীলকণ্ঠী ময়ূর, সঙ্কটে জাতীয় পাখি
Blue-throated peacock on the verge of extinction, national bird in danger

Truth Of Bengal: রাজস্থানের জয়সলমিরের মতোই ময়ূরের দেখা মেলে হুগলির রাজহাটে। গান্ধিগ্রাম, ভাদুরিয়া, সুগন্ধা, আমপারা, আলিআসকেপুর অঞ্চলে মনের আনন্দে নেচে বেড়াত ময়ূর-ময়ূরী। ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর ঘুরে বেড়ায় গ্রামের মেঠো পথে। শুধু তাই নয়, খাবারের সন্ধানে বাসিন্দাদের বাড়িতে হামেশাই ঢুকে পড়ে তারা। কুন্তি ও সরস্বতী এই দুই নদীর মাঝে থাকা সুবিশাল এলাকা পোলবার রাজহাট। গাছ-গাছালি দিয়ে ঘেরা সাধারণ এক গ্রাম। তবুও ব্যতিক্রমী এই গ্রাম। এখানে মানুষের সঙ্গে সহবাস্থান ময়ূর-ময়ূরীদের। খাবার থেকে চিকিৎসা, সবটাই ভালবেসে করেন গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামবাসীরা অনেকেই ময়ূরকে ভালবেসে নামও রেখেছেন। পুটুপুটু, রুমকি-ঝুমকি বলে ডাক দিলেই চলে আসে খাবার খেতে।
গত পাঁচ থেকে ছ’বছর আগেও গ্রামে ময়ূর-ময়ূরীর সংখ্যা ছিল অনেক। একটি ঝাঁকে প্রায় পাঁচশো থেকে সাতশো ময়ূর-ময়ূরী ঘুরে বেড়াত দলবেঁধে। যদিও এখন সেই সংখ্যাটা অনেক কমে গিয়েছে। কুন্তি নদীর পারে বাঁশ বনে বসবাস করত ময়ূরেরা। সেখানে প্রকৃতির কোলে ডিম পারত তারা। নদী বর্তমানে গতিপথ হারিয়ে স্থির হয়ে গিয়েছে। সাফ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল, কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ। চুরি হয়ে যাচ্ছে ডিম। তার উপরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শিলাবৃষ্টিতে অনেক সময় ময়ূরের মৃত্যুও ঘটেছে। এছাড়া কুকুরের কামড়েও জখম হয়েছে ময়ূর। পর্যটকরা গ্রামে ঘুরতে এসে ময়ূরে দেখা পেলেই কাছে চলে যায়। এমনকি পিকনিক করতে আসা মানুষেরা বক্স বাজায়, তার আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় ময়ূর। গ্রামবাসীরা নিষেধ করলেও শোনেন না তাঁদের কথা।
কোথা থেকে এলো এই ময়ূর ?
স্থানীয় বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ কোল্লার কথায়, এলাকার ময়ূরের আগমন ঘটে প্রায় এক থেকে দেড়শ বছর আগের। রাজহাট পশ্চিম পাড়ার ডাক্তার নীলমণি চক্রবর্তীর পরিবার ছিল জমিদার। বাড়িতে দু’টি ময়ূর-ময়ূরী থাকত। বংশবিস্তার করে সেটা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়। পরবর্তীকালে ধ্বংস হয়ে যায় জমিদারি। তখনই থেকেই খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াতে থাকে ময়ূরেরা। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু বর্তমানে গাছ কেটে ফেলার ফলে জঙ্গল সাফ হয়ে যাচ্ছে, তাই তাদের খাদ্যের অভাব দেখা দিচ্ছে। এই ময়ূরদের বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছে গ্রামবাসীরা। নিজেদের সংসার খরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে গান্ধিগ্রামের কোল্লা পরিবার ময়ূরের খাবারের ব্যবস্থা করেছে।
প্রতিদিন সকাল-বিকেল দু’বেলা করে খেতে দেয় তাদের। কয়েক কুইন্টাল চাল, গমের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। এছাড়া স্থানীয় বিধায়ক ও পুলিশও ভালবেসে ময়ূরের খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। বর্তমানে তা খেয়েই বেঁচে আছে কয়েকটি নীলকণ্ঠী ময়ূর।
স্থানীয় বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ কোল্লা বলেন, ‘ময়ূরকে বাঁচাতে গেলে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা রাজহাট এলাকার একটা ঐতিহ্য। ময়ূরদের জন্য অনেক খাবার লাগে, খাবার না পেয়ে তারা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে যাচ্ছে। চালের থেকেও গম তাদের কাছে বেশি পছন্দের। যদিও তাদের যে খাবার বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, তা এখন তারা সেভাবে পায় না। সরকারের বিভিন্ন দফতরে আবেদন জানিয়েও সেভাবে সারা মেলেনি। তাই ময়ূর বাঁচাতে গেলে চাই সরকারি উদ্যোগ।’
হুগলি জেলা পরিষদের সভাধিপতি রঞ্জন ধারা জানান, ‘রাজহাট এলাকায় অনেক ময়ূর থাকে। বর্তমানে এই জায়গার নাম হয়ে গিয়েছে ময়ূরমহল। ময়ূরদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, তা নিয়ে এর আগেও আমরা বিভিন্নভাবে প্রচার চালিয়েছি। জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি ময়ূরের যাতে থাকা খাবার কোনও অসুবিধা না হয়। এ দিকেও আমরা নজর দিচ্ছি। ওই এলাকায় যাতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় সেদিকেও আমরা নজর দেব।’ নিজেদের নামের মর্যাদা রাখতে ময়ূর এখনও সাতরঙা পেখম মেলে ময়ূরীকে নাচ দেখায় ঠিকই কিন্তু মন ভাল নেই জাতীয় পাখির। তাদের সঠিকভাবে দেখভাল না করলে একদিন হয়তো তাদের ঠাঁই হবে ইতিহাসের পাতায়।