দেশ

কাশ্মীর-হরিয়ানার ফলাফল কি শক্তিশালী করবে ‘ইন্ডিয়া’কে?

Will the Kashmir-Haryana result strengthen India

Truth of Bengal, সুমন ভট্টাচার্যঃ জম্মু-কাশ্মীর এবং হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটের ফলাফল কী হতে পারে? উত্তর ভারতের এই দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোলে কি কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি আরও চাপে পড়ে যাবে? জম্মু-কাশ্মীর এবং হরিয়ানা বিধানসভার নির্বাচনের পরেই মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে বিধানসভার ভোট হওয়ার কথা। আসলে এই ৪ রাজ্যের বিধানসভার ভোটই একসঙ্গে হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা ভোটের জন্য বাড়তি নিরাপত্তারক্ষীর প্রয়োজন, এই অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে ভোট এখনও করায়নি। বিরোধীদের অভিযোগ, একসঙ্গে ৪ রাজ্যের ভোট হলে বিজেপির ভরাডুবি হতে পারত, এই আশঙ্কা থেকেই গেরুয়া শিবির মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচন পিছিয়ে দিয়েছে। গেরুয়া শিবিরের রাজনৈতিক অঙ্ক ছিল জম্মু-কাশ্মীরে জামাতকে নামিয়ে দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসিয়ে সেখানে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে বেকায়দায় ফেলবে।

জম্মু-কাশ্মীরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের দুই শরিক কংগ্রেস এবং ওমর আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরে এটাই প্রথম ভোট। তাই এই পাহাড়ি রাজ্যে কী ধরনের ভোট হতে পারে, সেটা আন্দাজ করেই বিজেপি কংগ্রেস-ন্যাশনাল কনফারেন্সের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরাতে চেয়েছিল। নিজেরা জম্মুর বাইরে সুবিধা করতে পারবে না বুঝে কেন্দ্রের শাসকদল কাশ্মীর উপত্যকায় জামাতকেই তুলে ধরে বাজিমাত করতে চেয়েছিল।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভোটের যা প্রবণতা, তাতে কাশ্মীর উপত্যকার মুসলমানরা বিজেপির কৌশল বুঝতে পেরে তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয়নি বলেই সবাই মনে করছে। যখনই বিপদে পড়ে, তখনই গেরুয়া শিবির যে তাদের ‘প্রক্সি’ হিসেবে কোনও মুসলমান দলকে তুলে ধরে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসানোর কৌশল নেয়, বিরোধী দলগুলি এই অভিযোগ অনেক দিন ধরে করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস তো যেমন বলেই, আসলে আব্বাস সিদ্দিকী-নওসাদ সিদ্দিকীদের আইএসএফকে তৈরি করাই হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসানোর জন্য।

তৃণমূল বলে, সেই কারণেই নওশাদ সিদ্দিকী কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা পান, আর তাঁর সঙ্গে বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীর হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে যায়! যদি জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপির সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করার কৌশল কাজে না দেয়, তাহলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পোয়াবারো। এমনিতেই লোকসভা নির্বাচনের আগের থেকেই লাদাখ, যেখানে মূলত বৌদ্ধদের বাস, সেখানেও বিজেপির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের হাওয়া বইছে।

লাদাখের প্রাকৃতিক সম্পদ নরেন্দ্র মোদি, তাঁর ব্যবসায়ী ‘বন্ধু’দের হাতে তুলে দিয়ে চিন লাগোয়া ওই পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে চান, এমনতর অভিযোগেই লাদাখ উত্তাল হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ৯০টি আসনের মধ্যে যদি কাশ্মীর উপত্যকা এবং লাদাখ গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে রায় দেয়, তাহলে বিজেপির পক্ষে সেখানে কিছু করা মুশকিল।

আর কৃষক আন্দোলন থেকে মহিলা কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ, সব কিছুই যেভাবে জাঠ জাত্যভিমানে ধাক্কা দিয়েছে, তাতে দিল্লির পাশের রাজ্যও কেন্দ্রের শাসকদলের জন্য কঠিনতম রাজনৈতিক ‘রণাঙ্গন’। নরেন্দ্র মোদি নিজেও জানেন এই ‘কুরুক্ষেত্র’ ডিঙোনো তাঁর জন্য সহজ নয়। সেই কারণেই লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও সেই রাজ্যের ১০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৫টি বিজেপি হারিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের পরে গেরুয়া শিবিরের জন্য তেমন আশাপ্রদ কিছু ঘটেনি।

কংগ্রেসের পুরোনো নেত্রী কিরণ চৌধুরীকে দলে টেনেও বিজেপি বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধা করতে পারবে, এমনটা মনে করা হচ্ছে না। কুস্তিগিররা, মানে মহিলা কুস্তিগিরদের মধ্যে যাঁরা প্রতিবাদী মুখ ছিলেন, তাঁরা কংগ্রেসের হয়ে সরাসরি প্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে বারবার হরিয়ানায় যাচ্ছেন, অসংখ্য মিছিল করছেন। কিন্তু তাতেও কি জাঠেদের আহত হৃদয়ে প্রলেপ লাগানো সম্ভব হচ্ছে? সম্ভবত জাঠেদের আহত হৃদয়ে যে প্রলেপ লাগানো সম্ভব হচ্ছে না, সেটা আন্দাজ করেই গত পাঁচ বছর যাঁর সাহায্য নিয়ে বিজেপি হরিয়ানায় সরকার চালিয়েছিল, সেই দুশমন্ত চৌতালা গেরুয়া শিবিরের সরকারে শরিক হওয়ার জন্য প্রকাশ্যেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন।

হরিয়ানার পুরোনো রাজনৈতিক পরিবার চৌতালারা ভালোই বুঝতে পারছেন যে, ক্ষমতার ভাগীদার হতে গিয়ে কৃষক আন্দোলনের সময় বিজেপির সঙ্গে থাকাটা তাঁদের জন্য রাজনৈতিক ‘হারাকিরি’ হয়ে গিয়েছে। ফলে গত বিধানসভা নির্বাচনের পর যেমন বিজেপি সরকার গড়তে পেরেছিল চৌতালাদের সমর্থন নিয়ে, এবার গেরুয়া শিবিরের পক্ষে সেইরকম কোনও প্রত্যাশা থাকলেও পূরণ হবে না। যদি জম্মু-কাশ্মীর এবং হরিয়ানায় বিজেপির আশাভঙ্গ হয়, তাহলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তার কী প্রভাব পড়বে? এইটুকু নিশ্চিন্তে বলা যায় সেক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের বিজয়রথের চাকা যে আর দিল্লির বাইরে বেশি এগোতে পারছে না, তা প্রমাণ হয়ে যাবে।

এবং সেই ব্যর্থতার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদারদের গলার আওয়াজও স্তিমিত হয়ে আসবে। জম্মু-কাশ্মীরের থেকে শিক্ষা নিয়ে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতারা বুঝবেন, সবসময় রাজ্যভাগের কৌশল রাজনৈতিক ‘ডিভিডেন্ড’ দেয় না, ‘উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য করতে হবে’ বলে বেশি চিৎকার করলে সজোরে চপেটাঘাত জুটতে পারে।

আর হরিয়ানার থেকেও শুভেন্দু অধিকারী শিক্ষা পাবেন, যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি সবসময় ডিভিডেন্ড দেয় না। আমজনতার কাছে জিনিসপত্রের দাম থেকে চাকরি-বাকরি অনেক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। সবসময় ‘পাকিস্তান’-এর উল্লেখ, সংখ্যালঘুদের কটূক্তি এবং গো-রক্ষার নামে পিটিয়ে হত্যা যদি হরিয়ানায় বিজেপিকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না দেয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও গেরুয়া শিবিরের জন্য ‘লবডঙ্কা’ই জুটবে।

বরং বাম এবং অতি বামেদের সুরে সুর মিলিয়ে বিজেপির যেসব নেতা-নেত্রীরা এই বঙ্গেও পুজো বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, তাঁরা হয়তো না জেনেই হিন্দু ভোটের একাংশকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো সেই নেত্রী, যিনি হরিয়ানায় নিহত বাঙালি যুবক সাবির মল্লিকের খুনের প্রতিবাদ করেন, আবার সবাইকে শান্তিতে দুর্গাপুজো উদযাপনের জন্যও বলেন।

জম্মু-কাশ্মীর এবং হরিয়ানা বিধানসভা ভোটের ফলাফল যদি গেরুয়া শিবিরের জন্য আশাপ্রদ না হয়, তাহলে মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে কোন রাজনৈতিক কৌশলকে পুঁজি করে বিজেপি এগোবে? ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ইতিমধ্যেই চম্পাই সোরেনকে দলে নিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের আত্মীয়দেরও দলে টেনেছে। কিন্তু তাতেও কি আদিবাসীদের ক্ষতে প্রলেপ লাগানো যাবে? বিশেষ করে যেখানে ঝাড়খণ্ডে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এটাকেই প্রচারের মূল উপজীব্য করছেন, যে দেশের একমাত্র আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রীকে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা ‘মিথ্যা অভিযোগ’-এ জেলে পুরেছিলেন।

আদিবাসী ভোট যদি হেমন্ত সোরেনের দিকে ঢলে পড়ে, তাহলে গেরুয়া শিবিরের বিপদ। সেইজন্যই ঝাড়খণ্ডে ইতিমধ্যেই ‘সাম্প্রদায়িক কার্ড’ বিজেপি খেলতে শুরু করেছে। স্বয়ং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, তাঁরা ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতায় ফিরলে ওই রাজ্যে এনআরসি হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে মুসলিমরা নাকি অনুপ্রবেশ করে ঝাড়খণ্ডের জনভিত্তিকে বদলে দিচ্ছে, এমনটাই গেরুয়া শিবিরের অভিযোগ।

কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে যেখানে খাস উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাস কাজ করেনি, সেখানে ঝাড়খণ্ডে সেই প্রচার আদিবাসীদের মন গলাবে? হেমন্ত সোরেন তো মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শেষবার যখন বিজেপি ঝাড়খণ্ডে ক্ষমতায় এসেছিল, তখন তারা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রঘুবর দাসকে বেছেছিল, যিনি আদিবাসী ছিলেন না। তাই উৎসবের মরশুম গেরুয়া শিবিরের জন্য খুব আশার আলো না-ও নিয়ে আসতে পারে। জম্মু-কাশ্মীর এবং হরিয়ানায় তারা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। পরের দুই রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনেও তারা খুব স্বস্তিতে নেই। এবার তাই গেরুয়া শিবিরের জন্য দীপাবলির উৎসব তেমন আলোকোজ্জ্বল না-ও হতে পারে।

Related Articles