
সিরাজুল ইসলাম
‘গণতন্ত্রের মন্দির’ বলা হয় সংসদকে। সংসদীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রের মন্দিরে বিরোধীদের ভূমিকা অসীম। জনগণের প্রতিনিধি হয়ে বিরোধী সাংসদরা সংসদে তুলে ধরেন মানুষের কথা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সরকারের ভুল। সরকারকে ঠিক পথে চালিত করতে বাধ্য করেন। দেশের সংবিধান গণতন্ত্রে বিরোধী এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে। সেই বিরোধীদের ওপর কালে কালে নেমে এসেছে শস্তির খাঁড়া। অবরুদ্ধ করা হয়েছে তাদের কণ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসকপক্ষ পেশিশক্তির আস্ফালন দেখায়। বিরোধীদের দমিয়ে দেয়। বিরোধীদের কথায়, সরকারপক্ষ এইভাবে ‘তানাশাহি’ চালায়। সরকারপক্ষের সেই ‘তানাশাহি’ দেখা গেল চলতি অধিবেশনে।
একটি অধিবেশন থেকে কয়েক দফায় সাসপেন্ড করা হল ১৪১ জন সাংসদকে। কোনও একটি অধিবেশন চলাকালীন এক সঙ্গে এত জন সাসপেন্ড করার ঘটনা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে নজিরবিহীন। স্বাধীনতার পর থেকে এমন ঘটেনি দেশে। এই প্রয়াসকে বিরোধীশক্তিকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা দেখছে রাজনৈতিক মহল। সংসদে সরকারপক্ষ তাদের কথা বলবে। বিরোধীরা সেই সরকারকে প্রশ্ন করবে। সেই চাপে সরকার কখনও কখনও বদলাতে বাধ্য হবে সিদ্ধান্ত। এটাই রীতি আমাদের দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায়। সংখ্যায় তারা কম বলে বিরোধীদের মর্যাদা দেওয়া হবে না। শাসকপক্ষে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দেখাবে— এমন প্রবণতা স্বাস্থ্যকর নয় গণতন্ত্রের জন্য। যা চলছে এখন।
কোনও একটি অধবেশন চলাকালীন এক সঙ্গে এত জন সাসপেন্ড করার ঘটনা দেশের সংসদীয় ইতিহাসে নজিরবিহীন। সোমবার প্রথমে লোকসভা থেকে ৩৩ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করেন স্পিকার ওম বিড়লা। পড়ে রাজ্যসভা থেকে ৪৫ জনকে সাসপেন্ড করেন চেয়ারম্যান জগদীপ ধনকড়। গত ১৪ ডিসেম্বর শীতকালীন অধিবেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ১৫ জন সাংসদকে। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন লোকসভা, আর ১ জন ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ। তারপর সোমবার মোট ৭৮ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়। মঙ্গলবারও ৪৯ সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সংসদের ইতিহাসে একসঙ্গে এত সাংসদকে সাসপেন্ড করার ঘটনা কার্যত নজিরবিহীন। এই ঘটনায় বিরোধীদের দাবি, গণতন্ত্রের পীঠস্থান থেকে বিরোধীদের শূন্য করে দেওয়ার ছক করছে শাসকপক্ষ।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে মানে সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এমন মানসিকতা দেখালে সেই সরকার অনেক সময় ভুল পথে যেতে পারে। এমন অনেক কাজ করে যা জনস্বার্থ বিরোধী। সরকার যাতে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে না পারে তার জন্য বিরোধী দল সজাগ হয়ে পথে দেখায়। সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে ঠিক পথে চলার দিশা দেখাতে পারে। বিরোধী দল গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল মনোভাব নিয়ে সরকারের আপত্তিকর নীতির বিরোধিতা করবে। সরকারের বিভিন্ন দোষত্রুটি দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরবে। জনগণের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপে রাখবে। এটাই ভূমিকা বিরোধীদের। চলতি অধিবেশনে সেটাই করেছিল বিরোধীরা।
চলতি অধিবেশনে গণতন্ত্রের মন্দিরে অবাঞ্ছিত ভাবে প্রবেশ করেছিলেন দুই যুবক। স্মোক ক্যানিস্টার খুলে ধোঁয়া উড়িয়েছিলেন। যা সংসদের নিরাপত্তার গলদ সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন ওঠে যেখানে সংসদ সুরক্ষিত নয়, সেখানে কী করে সুরক্ষিত থাকবে দেশের জনগণ? একযোগে এই প্রশ্ন তুলতে থাকেন বিরোধী সাংসদরা। দাবি করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি। বিরোধীদের এই ভূমিকা ভাল চোখে দেখেনি শাসকপক্ষ। তাই তাঁদের ওপর নেমে আসে নজিরবিহীন শাস্তির খাঁড়া। প্রশ্ন উঠছে, সরকারপক্ষের কাছে কেন এই প্রশ্ন তুলতে পারবে না বিরোধীরা? প্রশ্ন তুললে কেন নেমে আসবে শাস্তির খাঁড়া? দেশের জনগণের প্রতিনিধি হয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন করেন। উত্তর না পেলে ঠিক সময়ে উত্তর দেয় দেশের জনগণ। এটার রীতি। এটাই পরম্পরা।