
The Truth of Bengal: ভোজনরসিক বাঙালির খাবারের তালিকা সুদীর্ঘ। কি নেই সেখানে! টক থেকে মিষ্টি, তেতো থেকে ঝা্ল, চচ্চড়ি। আর তাইতো কলকাতার অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির নস্টালজিয়া। কফি হাউসের গল্পের আড্ডায় কফি হাতে তুফান তোলা হোক কিংবা সাহেবি ঢঙে পিটার ক্যাটের সিজলারের ধোঁয়ায় শনিবাসরীয় সন্ধ্যার মওতা। কিন্তু আপনি কি জানেন এই সমস্ত নস্টালজিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। আপনাদের জন্য আমাদের এই পর্বে প্রতিদিনই থাকবে সেই সমস্ত ইতিহাসের কিছু টুকরো সন্ধান।
এই বই আসলে হাতে তৈরি এই, কিংবা ডাউন মো ,পাইস ইনফিউশন, কবিতা আর আড্ডা, সবচেয়ে আহক সবচেয়ে সাহসী সেগুলো আজও এখনও আজও রাজনীতি কোথায় আলো ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেইকোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো..কফি হাউসের *কথায় মান্না দে’র সেই গান সামনে চলে আসবেইমাঝে আবার কফি হাউস খোলার পর অর্ডার করে বসার পর আমারও অনেকের মতো সেই কারণেই এ আড্ডা দেওয়ার টোস্ট আর ঘুগনি বিবরণ। আবার মান্না দের কালজয়ী গানটার কথাই মনে পড়ে গেল। জুনের বর্ষণ সিক্ত ও করোনা তাপিত এই সময়টায় কলকাতার বিকেলগুলো খুব সোনালি নয়, চিরপরিচিত কলেজ স্ট্রিটও কেমন যেন অপরিচিত ঠেকে। সারি সারি বন্ধ দরজা, ফাঁকা রাস্তা, মন খারাপ করা বিকেল আর যাই হোক, পুলক দেয় না। শহরের ল্যান্ডমা হয় ‘তবু কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে আমার এমন একটা নাড়ির, না নারীর টান, যে কফি হাউস খুলেছে শুনলে আসতেই । জানলা দিয়ে চুপচাপ পাশের স্কুল বাড়িটা দেখতে হয়, যে জীবনের বেশ কিছু বর্ষা এবং বসন্ত আমার কেটেছে। ওই স্কুল বাড়িটায়, মানে ডিরোজিও, মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিধন্য হিন্দু স্কুলে ক্লাসে অন্যমনস্ক হলে স্যাররা ধমক দিয়ে বলতেন, এমন চড় মারব সোজা কফি হাউসের সামনের রাস্তায় গিয়ে পড়বি।
যেহেতু কৈশোরের ওই বয়সে হওয়ার অনেক কারণ ছিল, তাই মনে হত থাপ্পড় খাওয়াটাই বোধহয় ভাল, সোজা কফি হাউসে ঢুকে যাওয়া যাবেকে জানত, তিরিশ বছরের একটু বেশি সময়ের ব্যবধানে আমার স্কুলের সেই স্যার আর চড় মারার জন্য থাকবেন না ঠিকই, কিন্তু এক ভাইরাস এমন থাপ্পড় মারবে যে, কফি হাউসে ঢুকে তো পড়তে পারব, কিন্তু কোনও টেবিলে বসে থাকা কোনও পরিচিত হাত নেড়ে ডাকবে নাগৌরীপ্রসন্ন লেখা গানের প্রতিটি শব্দ সত্যি মনে হবে করোনা কালের কফি হাউস। দেড় বছরের এই অতিমারি সত্যিই তো জানিয়ে দিয়ে গিয়েছে, আর কোনও কোনও বন্ধু আজ কবরে বিলীন কিংবা চিতার ছাই হয়ে গিয়েছে। প্যারিসের যে আড্ডা দেখে ফিরে আসার পর সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারকে কফি হাউসের আড্ডা নিয়ে গান লিখতে অনুরোধ করেন, সেই সব ক্যাফেতে সব লেখকরা আড্ডা দিতেন। কামু থেকে কাফকা, কে ননসুপর্ণকান্তির সেই অনুরোধেই গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের আড্ডা, , মজলিশি মেজাজকে নিয়ে এমন গান লিখলেন, যা পরের চার দশক ধরে বাঙালিকে এক অদ্ভুত স্মৃতিমেদুর বুঁদ করে রেখেছেকফি হাউস মানেই কবিদের আড্ডা, শিল্পীদের মিলিউ কিংবা ভাবী চলচ্চিত্র চিত্রনাট্য নিয়ে কাঁটাছেড়াএবং গৌরীকিশোর ঘোষের ‘প্রতিবেশী’ উপন্যাসের মতো এখনও কফি হাউসের নীচে কোনও শামিম আর অমিতার দেখা হওয়ার কথাও। তাই কফি হাউস খুলে যাওয়াটা আমার জন্য ।
কোনও সুজাতা আমার জন্য চিকেন অর্ডার দেবে না নিশ্চিত জেনে, নিজের জন্য সেইসব কিছুই বলে দিয়ে স্মার্ট ফোনে ছবি তুলে প্রবাসী সুজাতাদের পাঠিয়ে দিই এবং মনে মনে এই ভেবে পুলকিত হই যে নিশ্চয় এখনও ঈর্ষার রঙ সবুজই। সুনীল বা শক্তি মতো কবিতা নাই লিখতে পারলাম, কিন্তু নীরাকে ভেবে নিতে অসুবিধে কোথায়! আসলে কলেজ স্ট্রিট জায়গাটা এমনই একটা পাড়া যে, এখনও এখানে মার্সিডিজ বা চড়ে আসা বিত্তবানের চাইতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে মফস্সল থেকে বই কিনতে আসা কিংবা তরুণ কদর বেশি। এখনও ভীরু তরুণী লেখকদের অটোগ্রাফ চায়, ব্র্যান্ডেড শার্টের চাইতে চে’র ছবি আঁকা টি-শার্ট নিয়ে কৌতূহল বেশি থাকে। সেই জন্যই কলেজ স্ট্রিট মানেই কফি হাউস, কলেজ স্ট্রিট মানেই প্যারামাউন্টের শরবত, পুঁটিরামের কচুরি আর ছোলার ডাল। কফি হাউসের যদি শিকড় থাকে অ্যালবার্ট হলে, তাহলে তো ১০০ বছর পেরিয়ে যাওয়া ডালপালা বিস্তৃত মহীরুহের মতো একটা শরবতের দোকান ১৯১৮-তে বিপ্লবী আন্দোলন শুরুর সময় বরিশাল থেকে কলকাতায় চলে আসা নীহার রঞ্জন মজুমদার এই ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন। আপনি যতই সিডনি অপেরা হাউসের পাশে বসে ওরেও শেক খেয়ে থাকুন, কাঠের বেঞ্চিতে বসে আম পোড়া শরবত না খেলে, আপনার কলকাতাকে চেনা হয়নি। যে শরবত আর সিরাপ নাকি নেতাজি আর বারবার টেনে আনত, তা তো করোনা কালেও অমৃতসুধা আর কলকাতার বহতার নাগরিক স্মৃতির চিরায়ত প্রবাহ।