ফিচার

আন্দোলন হোক, আত্মঘাতী আস্ফালন নয়

Let it be a movement, not a suicidal boom

Truth of Bengal,পার্থসারথি গুহঃ পুজোতে অনেকবারই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবল বৃষ্টি, দুর্যোগ। সংবাদমাধ্যমের ভাষায় লেখা বা বলা হয়েছে দুর্যোগাসুর বা বৃষ্টিসুর-এর কথা। মহিষাসুরের চেয়েও মারাত্মক সেই প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা। এবার সেই আসরে অবতীর্ণ হয়েছে পুজোকে কেন্দ্র করে বাঙালির শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য ধ্বংস করার এক আত্মঘাতী রূপ।

আন্দোলন শেষ হইয়াও হইতেছে না। মঞ্চ খুলে নেওয়ার পরেও নাটক স্টেজ আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। কিছু মানুষ যাকে কটাক্ষ করে বলছেন স্বাস্থ্যভবনের সামনের খাদ্যমেলা। যদিও জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ জিবি মিটিংয়ের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শনিবার থেকে তাঁরা যে যাঁর হাসপাতালে ফিরবেন। এবং রোগীদের পরিষেবা দেবেন। তাতেও অবশ্য  কিছু যদি এবং কিন্তু রয়েছে। এমনকী ভবিষ্যতে তাঁরা ফের আন্দোলনে ফিরতে পারেন এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিও বিদ্যমান।

জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের আরও একটি ব্যাপারে বিলম্বিত বোধোদয় ঘটেছে। এতদিন পর শুক্রবার স্বাস্থ্যভবন থেকে মিছিল করে সিজিও কমপ্লেক্সের সিবিআই দফতরে যান তাঁরা। অথচ এই কথাটাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিন ধরে বলে আসছেন। দলের মুখপাত্ররা বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরব হচ্ছেন।

তিলোত্তমার ধর্ষণ ও খুনের পর কলকাতা পুলিশ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অভিযুক্ত সঞ্জয় রাই-কে গ্রেফতার করে। কিন্তু এর ক’দিন পরেই হাইকোর্টের নির্দেশে তিলোত্তমা তদন্তের ভার চলে যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে। অপর এক মামলার প্রেক্ষিতে বিচার স্থানান্তরিত হয় সুপ্রিম কোর্টে। তারপরেও স্বাস্থ্যভবনের সামনে মঞ্চ বেঁধে অবস্থান কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল।

যদিও জুনিয়র ডাক্তার এবং সমাজের একটি অংশকে খেপিয়ে তোলার পেছনে রাজ্যে অস্তিত্ব হারাতে থাকা বিরোধী দলগুলির প্ররোচনা ছিল নিশ্চিতভাবে। সবথেকে বড় কথা, বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো যখন সামনে তখন এই আন্দোলনের ফলে বাণিজ্যিকভাবে ভয়াবহ লোকসানের মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ডাক্তারবাবুদের অতিবিলম্বিত বোধোদয়ের পর তাঁরা যে পশরা সাজিয়ে বসবেন, বিকিকিনি হবে তাতে আবার বাধ সেধেছে ম্যান মেইড বন্যা।

বস্তুত, রাজ্যকে না জানিয়ে ডিভিসি-র মাত্রাতিরিক্ত জলছাড়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গের এক বিস্তীর্ণ অংশ এখন জলের তলায়। আমফান থেকে ইয়াস–বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজ্যবাসীর পাশে থাকতে যিনি বিনিদ্র থাকেন, সেই মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারেও যথারীতি বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। উই ওয়ান্ট জাস্টিসের দাবি তোলা তারকাদের কিন্তু এই প্রবল দুর্যোগে দূরবিন দিয়েও দেখা যাচ্ছে না।

দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি। নিশ্চিতভাবে মনে আছে হেলথ ড্রিঙ্কের এই জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের কথা। কিছুদিন ধরে কলকাতায় আন্দোলনের নামে  ঠিক এভাবেই যেন নিজেদের উচ্চতা প্রদর্শনীর নেশায় মেতেছে শহরের একাংশ। হেলথ ড্রিঙ্কের সঙ্গে তারতম্য রেখে হেলথ সেক্টরের একটা অংশ এতে অগ্রণী হয়েছে। অসুস্থ মানুষকে সুস্থতার পথে নিয়ে যাওয়া যাঁদের ব্রত তাঁদের কেউ কেউ এই অদ্ভূত অসুস্থতার কোমায় আচ্ছন্ন। এতে আর যাই হোক সমাজের ভাল হতে পারে না। আত্মঘাতী এই নেশা ড্রাগসের নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর। সাংঘাতিক তার আফটার এফেক্টস।

প্রতিনিয়ত তাঁরা দেখাতে ব্যস্ত আন্দোলনের বহর কত! কতজন তাঁদের সঙ্গে শামিল হয়েছেন। কতজন তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মোদ্দা কথা, এ হল আন্দোলনের ফ্যাশন প্যারেড। আন্দোলনের নামে সেলফি তোলা, পিকনিকের মেজাজে আড্ডায় মেতে ওঠা। তিলোত্তমাকে সামনে রেখে অনেক সেলিব্রিটি তো কার্যত নিজেদের আসন্ন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির প্রোমো পর্যন্ত সেরে নিচ্ছেন।

সেটা আবার গর্ব করে বলছেনও তাঁরা। জুনিয়র ডাক্তারদের যে অংশ আন্দোলনের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন মুমূর্ষু রোগীরা বাঁচলেন কী মারা গেলেন, সেদিকে তাকানোর ইচ্ছে হয়তো লুপ্ত হয়েছে তাঁদের। এর ফলে গত ৪০ দিনে বিনা চিকিৎসায় বেশ কয়েকজন সহনাগরিককে হারিয়েছি আমরা। একমাত্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেই হতভাগ্য পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়ে ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন ২ লাখ টাকা করে দেওয়ার।

না, দু -লাখ টাকায় বিনা চিকিৎসায় মৃত মানুষটি তাঁর স্বজনের কাছে ফিরবেন না। তাও মুখ্যমন্ত্রী এই ভয়ঙ্কর বিপদে মাতৃসুলভ ভূমিকায় তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এই বা কম কী! মানুষের জীবন বাঁচানোর অঙ্গীকার করা জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনের মেকি আতিশয্যে সেই দায়িত্ব কার্যত বিস্মৃত হয়েছেন। ওই যে আন্দোলন নামক অবক্ষয়ে বহমান তাঁরা। অথচ যাঁর জন্য এত কিছু, যাঁর জন্য এই আন্দোলন সেই তিলোত্তমার শাস্তির চেয়েও এখন যেন প্রধান দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার। যেনতেন মূল্যে মুখ্যমন্ত্রীকে সরাতে হবে। মানুষের ভোটে নিরঙ্কুশ ভোটে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে হঠানোই এই নেশারুদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য।

মাত্র কদিন আগের লোকসভা ভোটে বিপুল সংখ্যক আসন পেয়ে তৃণমূল প্রমাণ করেছে পশ্চিমবঙ্গে তাদের অশ্বমেধের ঘোড়া অপ্রতিরোধ্য। তাও শূন্য পাওয়া শক্তিও ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে চিৎ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। হ্যাঁ, এটা জোর দিয়ে বলাই যায় সামনে জুনিয়র ডাক্তারবাবু থাকলেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে বিরোধী অপশক্তি।

আন্দোলন কলকাতা প্রচুর দেখেছে। কিন্তু এমন আত্মঘাতী আন্দোলন সত্যিই আমরা দেখিনি। অথচ কলকাতার কী বিশাল সুনাম আতিথ্যের, সৌজন্যের। এখন সে জায়গায় শুধু আন্দোলনের নামে ধ্যাষ্টামো চলছে। আন্দোলন যদি প্রকৃত আন্দোলনের নামে হতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন যা চলছে তা কখনই সমাজের পক্ষে হিতকর হতে পারে না। প্রকৃত আন্দোলন কলকাতা তথা রাজ্য বারংবার দেখেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে।

সিঙ্গুর,নন্দীগ্রামের আন্দোলন ছিল সাধারণ মানুষের লড়াই। ইস্যু থেকে কখনও বিচ্যুত হননি তৎকালীন বিরোধী নেত্রী। অথচ এখনকার আন্দোলনকারীরা কিন্তু অনেকদিন আগেই তিলোত্তমার আন্দোলন থেকে সরে গিয়েছেন। পরিচালিত হয়েছেন রাজনৈতিক ক্রীড়নকদের দ্বারা। যার মধ্যে বাম-বিজেপি উভয়ই বর্তমান।

যদিও এরমধ্যে শুভবুদ্ধির যে উদয় ঘটেনি তা নয়। রাজ্য সরকারের বাড়িয়ে দেওয়া উদারহস্তের প্রতি সহৃদয় হয়ে চিকিৎসকদের একাংশ মাঝেমধ্যেই চেয়েছে আলোচনার টেবিলে বসতে। আশা করা যায়, রাজ্য সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগে তাঁরা আর জল ঢেলে দেবেন না। কায়মনোবাক্যে এটাই চাইছে রাজ্যবাসী।

Related Articles