সম্পাদকীয়

রামানুজন: গণিত জগতের বিস্ময়কর প্রতিভা

Ramanujan: The Amazing Genius of the Mathematical World

Truth Of Bengal: রাজু পারা: অঙ্ক কষতে হবে শুনলেই বুক কাঁপে না এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর বিষয়টি যার কাছে ছিল জলভাত তিনি শ্রীনিবাস রামানুজন (১৮৮৭-১৯২০)। অঙ্কের প্রতি তাঁর আগ্রহ গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকেই। চোখের পলকে কষে ফেলতে পারতেন কঠিন কঠিন অঙ্ক। ভাবলে বিস্ময় জাগে ফোর্থ ক্লাসে পড়ার সময় করে ফেলতেন স্নাতক পর্যায়ের অঙ্ক। ছেলেবেলায় একবার মহামারি ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।

দু’বছর বয়সে একবার বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। সে বারেও বেঁচে যান। কিন্তু মুখে রয়ে যায় বসন্তের দাগ। এরপর দশ বছর বয়সে কলেরা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে সে বারেও তিনি বেঁচে যান। হেরে গেলে কেবল ভারতবাসী নয়, বিশ্ববাসী সেদিন হারাত গণিত জগতের এই বিস্ময়কর প্রতিভাটিকে।

২২ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম দিনটিকে ‘জাতীয় গণিত দিবস’ এবং ২০১২ সালকে ‘জাতীয় গণিত বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। কিংবদন্তি এই মহাপুরুষটি’র ৭৫তম জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতীয় ডাক বিভাগ একটি ডাক টিকিটও প্রকাশ করেন।

বিস্ময়কর গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করা আমাদের সাধ্যের অতীত। ভয়াবহ দারিদ্র্য, অযোগ্য শিক্ষা ব্যবস্থা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, কেমব্রিজে থাকার সময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এবং ভারতবর্ষের পরাধীনতা সবই রামানুজনের উন্নতির বিরুদ্ধে, তাঁর খ্যাতি অর্জনের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।

তা সত্ত্বেও রামানুজন বড় হয়েছেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সম্মানের উচ্চ শিখরে। এত প্রতিকূলতা না থাকলে তিনি হয়তো আরও বড় হতে পারতেন, আরও অনেক স্বীকৃতি তাঁর কপালে জুটত। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যতটুকু সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন তা আমাদের উৎসাহ জোগায়, অনুপ্রাণিত করে।

১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মাদ্রাজের এড়োর শহরে, কাবেরী নদীর তীরে, মামারবাড়িতে জন্ম নেন গণিতবিদ রামানুজন। তাঁর বাবা শ্রীনিবাস কুপ্পুস্বামী আয়েঙ্গার এড়োর শহরের ২০০ কিমি পূর্বে এক কাপড়ের দোকানে খাতা লেখার কাজ করতেন। আর পাশে থেকে অভাব-অনটনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতেন স্ত্রী কোমলতাম্মল।

রামানুজনের পরিবার ছিল নানাবিধ জাতপাত, কুসংস্কার, আচারবিধি-অনুষ্ঠানের বাঁধনে বাঁধা। তা সত্ত্বেও রামানুজনের জীবনে মায়ের প্রভাব বড় বেশি লক্ষ্য করা যেত। বাল্যকালে মা কোমলতাম্মল তাঁকে পাশে বসিয়ে বেদ, উপনিষদ আর রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনাতেন। সে সব শুনতে শুনতেই প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেন রামানুজন। মনে জেগে ওঠে প্রবল ধর্ম বিশ্বাসও।

শান্তশিষ্ট, মুখচোরা, কম কথা বলা, রুগ্ন রামানুজন প্রথম দিকে ‘পিয়াল’ স্কুলে (মাত্র দশ-বারো জন পড়ানো হয় যেখানে) ভর্তি হলেও সাত বছর বয়সে ভর্তি হন কুম্ভকোনমের টাউন স্কুলের প্রাইমারিতে। এখানে তিনি শিখে নেন তামিল, সংস্কৃত ও পাটিগণিতের মতো বিষয়গুলি। এই স্কুল থেকেই প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষায় তিনি জেলার মধ্যে ‘প্রথম’ হন।

টাউন স্কুলে পড়ার সময়েই রামানুজনের মধ্যে দেখা গিয়েছিল বিস্ময়কর গণিত প্রতিভা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় অঙ্কের শিক্ষক ভাগের অঙ্ক  বোঝাতে গিয়ে বললেন, কোনও সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে এক।

যেমন, ‘তিনটি ফল তিনজনের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিলে প্রত্যেকে ফল পাবে একটা।’ রামানুজন তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘তা হলে শূন্যটা ফল শূন্য জনের মধ্যে ভাগ করে দিলেও কি প্রত্যেকে একটা করে ফল পাবে?’ স্বভাবতই  রামানুজনের প্রশ্নে শিক্ষক মহাশয় বিব্রত হন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন রামনুজনের গণিত মেধা।

গণিতের বই হাতে পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন রামানুজন। একটা অঙ্ক কষতে পারতেন বিভিন্ন পদ্ধতিতে। এই কৌতূহল তাঁর ছড়িয়ে পড়ে গণিতের বিভিন্ন  শাখাগুলিতে– বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতিতেও। স্কুলে সব শ্রেণির ছাত্রের কাছে রামানুজন তখন একজন মেধাবী ছাত্র হয়ে উঠলেন। নিজের ক্লাস তো বটেই, ওপরের ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর কাছে মাঝে মাঝে আসতে লাগল গণিতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। রামানুজন যতই সেই সব গণিতের সমাধান করতে লাগলেন, ততই তাঁর প্রতিভার বিকাশ হতে লাগল।

গণিত সাধনায় যে বইটি রামানুজনের জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলে সেটি জর্জ শুব্রিজ কারের লেখা ‘এ সিনপসিস অফ এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স’। বইটি ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয়। গণিতের ওই বইটি ছিল হাজার পাঁচেক সমীকরণের একটি সংকলন।

যাতে ছিল বীজগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাস, ইনটিগ্র্যাল ক্যালকুলাস-সহ গণিতবিদ্যার নানা শাখার সূত্র ও উপপাদ্য। কারের ওই বই থেকে রামানুজন একের পর এক সূত্র ও উপপাদ্য পড়ে নিজের মতো করে নিয়ম বের করে সেগুলি খাতায় লিখে রাখতেন। যা পরবর্তীকালে তাঁর বিখ্যাত ‘নোট বই’-এর রূপ নেয়।

১৯০৩ সালে রামানুজন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। ইংরেজি ও অঙ্কে বিশেষ পারদর্শিতার জন্যে ‘জুনিয়র সুব্রমনিয়াম’ বৃত্তিও লাভ করলেন। পরের বছরেই কুম্ভকোনমে’র সরকারি কলেজ এফএ কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে অঙ্ক ছাড়া কোনও কিছুতেই তিনি মাথা দিতেন না।

ফলে অন্যান্য বিষয়ে ফেল করলেন। যে বৃত্তি নিয়ে রামানুজন কলেজ ঢুকেছিলেন, পাশ করতে না পারায় সেই বৃত্তি কাটা গেল। সে সময়ে কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। কলেজ যোগ দেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কলেজে উপস্থিত না হওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারলেন না। ১৯০৬ সালে মাদ্রাজের পচাইয়াপ্পা কলেজ তিনি পুনরায় ভর্তি হলেন এফএ ক্লাসে। কিন্তু এখানেও তিনি শুধু অঙ্ক নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন রামানুজন।

ফিরে আসেন কুম্ভকোনমে বাবা-মায়ের কাছে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে একটা সরকারি চাকরি করে সংসারের অভাব দূর করবে। কিন্তু তার জন্যে চাই এফএ পাশ। রামানুজন পরীক্ষায় বসলেও পাশ করতে পারলেন না। বার বার ফেল করা রামানুজনের জীবনে ভীষণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেললো। তিনি হতাশ হয়ে পড়লেন দারুণ ভাবে। একদিকে নিদারুণ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই আর একদিকে এফএ ফেল– দুটো বিষয় তার ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

ভয়ানক দারিদ্র্যে তাঁকে বহুদিন অনাহারে থাকতে হয়েছে। তাঁর মনঃসংযোগ ও অনুশীলনে বাধা পেয়েছে। কিন্তু রামানুজন দমেননি, যতটুকু পেরেছেন প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন। আর মন দিয়ে অঙ্ক কষে গিয়েছেন। অর্থের অভাবে মাঝে মাঝে টিউশন করেছেন। বাবা চাইতেন না ছেলে শুধু অঙ্ক করুক। মা কোমলতাম্মল সংসারের প্রতি ছেলের মন ফেরাতে তাই বিয়ে দিলেন।

সংসারের দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় রামানুজনের তাই একটা চাকরির প্রয়োজন হয়ে পরে। অনেক ঘোরাঘুরির পর অবশেষে মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টস সেকশনে রামানুজনের চাকরি হয়। মাহিনা মাসে পঁচিশ টাকা। তাতে কী? চাকরির সময়টুকু বাদ দিয়ে ডুবে রইলেন গণিত গবেষণায়। গবেষণাগুলি লিখে রাখবার মতো কাগজ ছিল না রামানুজনের কাছে। অপেক্ষা করে বসে থাকতেন, কখন অফিস ছুটি হবে। সবাই চলে গেলে ফেলে দেওয়া কাগজ কুড়িয়ে এনে তার ওপর অঙ্ক কষে যেতেন।

মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং রামানুজনের গণিত প্রতিভাকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছিলেন। এই সময় রামানুজনকে দু’একজন পরামর্শ দিলেন গবেষণাপত্রগুলিকে প্রকাশ করার জন্যে। রামানুজন তাঁর কিছু কাজ (গাণিতিক সমস্যা) ‘ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি’র জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন যা ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয়।

একই জার্নালে পরের সংখ্যায় ‘Some properties of Bernoulli’s numbers’ শিরোনামে রামানুজনের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেটি ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত গবেষণাপত্র। পরে, ট্রিনিটি কলেজের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ অধ্যাপক জিএইচ হার্ডির সঙ্গে রামানুজনের পত্রালাপ চলে। হার্ডি মনোযোগ দিয়ে রামানুজনের পাঠানো প্রতিপাদ্যগুলি পড়ে ভীষণ অবাক হন। তেইশ বছরের যুবক এরকম অঙ্ক করেন কীভাবে? হার্ডি সে সময় রামানুজনকে বিলেতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও রামানুজন যেতে রাজি হননি। কারণ গোঁড়া হিন্দু পরিবারের ছেলে হয়ে কালাপানি পেরিয়ে বিলেতে যাওয়া সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। কুসংস্কারের জটাজাল তাঁকে ঘরেই বন্দি করে রাখল।

রামানুজনের গণিত গবেষণাগুলি ১৯১৪ সালে একটি, ১৯১৬ ও ১৯১৭ সালে সাতটি, ১৯১৮ সালে চারটি প্রকাশিত হয় ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন জার্নালে। ১৯১৮ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। দিনের পর দিন অধিক পরিশ্রমের ফলে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। কেমব্রিজের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল তাঁকে।

পরে ওয়েলস, ম্যালটক এবং লন্ডন শহরের স্বাস্থ্য নিবাসগুলিতে ভর্তি করা হলেও তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি  হতে শুরু করল দ্রুত। চিকিৎসকরা তাঁর যক্ষায় ভোগার কথা জানালেন। ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল রামানুজন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। সারা পৃথিবীতে আলোচিত হলেন তিনি। লন্ডন ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, নেচার পত্রিকা সকলেই সম্মান জানিয়েছিলেন তাঁকে।