সম্পাদকীয়

গানের ভুবনে চির যৌবন কিশোর কুমার

Kishore Kumar, eternal youth in the world of music

Truth of Bengal, রাজু পারাল: কিংবদন্তী গায়ক ও অভিনেতা কিশোরকুমার আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর অগণিত ভক্ত ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বজুড়ে। আকাশের সীমাহীন উদাস বাতাবরণের তলায় আজও তিনি রয়েছেন মানুষের সঙ্গে। কারণ তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। তাঁর নাম করলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এক প্রাণ চঞ্চল যুবকের চেহারা। যিনি স্টেজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে বেড়ান, পর্দায় অদ্ভুত মুখভঙ্গিমা করে দর্শকদের আকর্ষণ করে রাখেন। স্থির থাকতেন না একবিন্দুও। আসমুদ্র হিমাচল মুগ্ধ তাঁর গানের প্রেমে। গত আগস্ট মাসেই তিনি পার করেছেন ৯৫ তম জন্মতিথি।

গায়ক কিশোরকুমারের জন্ম মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায়, এক ব্রাহ্মন বাঙালি পরিবারে। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী, মা গৌরী দেবী। কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন পেশায় আইনজীবী। তাঁর চার ছেলে মেয়ের মধ্যে কিশোরকুমার ছিলেন সকলের ছোট। কিশোরকুমারের জীবনে মা গৌরীদেবী ছিলেন যাবতীয় প্রেরণার উৎস। মা’ই ছিলেন তাঁর কাছে বড় শক্তি ও আদর্শ। দিদি সতীদেবীর কাছে কিশোরকুমার বাল্যকলে গানের তালিম নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বোম্বে টকিজে দাদা অশোককুমারের সুবাদে শচীন দেববর্মন ও ক্ষেমচন্দ্র প্রকাশের সঙ্গে পরিচিত হন।

বোম্বে টকিজে কোরাস গায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেন কিশোরকুমার। দাদা অশোককুমার সেখানে যুক্ত থাকায় সুবিধাই হয়েছিল কিশোরকুমারের। তবে দাদার সান্নিধ্যে থেকে কিশোরকুমার অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলেও তিনি বেশি ভালোবাসতেন সঙ্গীতকে। কৈশোরেই মহান গায়ক কে এল সায়গলের বড় ভক্ত ছিলেন কিশোরকুমার। তাঁকেই গুরু মানতেন। প্রথমদিকে কিছু চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া গানের শৈলী অনুকরণ করলেও পরে নিজস্ব গানের একটা ধারা তৈরী করেন কিশোরকুমার। নিজের জীবনে কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করতেন কিশোরকুমার।

পরবর্তীকালে গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এই কথাটি মনে রেখো রবীন্দ্র সঙ্গীতটির রেকর্ড প্রকাশ করেন। তা শুনে বিশ্বভারতীর তৎকালীন মিউজিক বোর্ডের দুই সদস্যা কণিকা বন্দোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র কিশোরকুমারের গায়কির প্রশংসা করেন যথেষ্ট। ১৯৪৬ সালে ‘এইট ডেজ’ নামে একটি গানের কোরাসে প্রথম অংশগ্রহণ করেন কিশোরকুমার। ঐ বছরেই চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম আবির্ভাব। সেই ছবির নাম ‘শিকারি’ । বড়দা অশোককুমার ছিলেন ছবির নায়ক। এর ঠিক দু বছর পরে কিশোরকুমার ‘জিদ্দি’ ছবিতে গান করার সুযোগ পান।

১৯৪৯ সাল থাকে কিশোরকুমার মুম্বাইতে থাকতে শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ফণী মজুমদারের ‘আন্দোলন’ ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বড়দা অশোককুমারের সুপারিশে অনেক ছবি করার সুযোগ পেলেও তাঁর মন ভীষণ ভাবে টানত সঙ্গীতের দিকে। গায়ক হবার সুপ্ত বাসনা তাঁর মনে সব সময়ই জেগে থাকত। ১৯৫৪ সালে বিমল রায়ের ‘নোকরি’ ছবি থেকেই বলতে গেলে কিশোরকুমারের সঙ্গীত জগতের যাত্রা শুরু হয়। সেই ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী। প্রথমে তিনি কিশোরকুমারকে গান গাইবার সুযোগ দিতে চাননি।

সলিল চৌধুরীর যুক্তি ছিল, সঙ্গীতের ওপর কিশোরকুমারের প্রথাগত শিক্ষা নেই। তাই কাজটা তাঁকে দিয়ে হবে না। কিন্তু কিশোরকুমারের গান শুনে তিনি ভীষণভাবে অবাক হন। কিশোরকুমার সেই সুযোগটাকে যথাযথ কাজে লাগান। ‘ছোটা সা ঘর হোগা’ গানটি গেয়ে তখন থেকেই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সকলের কাছে। পরে পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জীর প্রথম ছবি ‘মুসাফির’ এ কাজ করেন। গায়ক হিসেবে মুম্বাইয়ের সিনেমা জগতে আলোড়ন তোলেন সে সময় থেকেই। সঙ্গীতের সর্বোচ্চ আসনে নিজেকে বসাতে সফল হন কিশোরকুমার। তবে, সঙ্গীতের পাশাপাশি অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোযক, সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার হিসেবেও তিনি জনগণের কাছে বিখ্যাত ছিলেন।

গানের ক্ষেত্রে তিনি শুধু যে হিন্দি বা বাংলা ভাষাতেই গেয়েছেন তা নয়, মারাঠি, অসমিয়া, গুজরাটি, কানাড়া, ভোজপুরী, উড়িয়া, মালয়ালাম এবং উর্দুতেও গান গেয়েছিলেন। সত্তর দশক থেকে বলিউডে হিরোর কনসেপ্ট ভেঙে গিয়ে অ্যাংরি ইয়ংম্যানের যুগ এলে অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, মিঠুন, সঞ্জয় দত্ত ও সানি দেওল প্রমুখ নায়কদের হাত ধরেই জন্ম নিল নতুন কথা, সুর ও কণ্ঠ। ঐ সব নায়কদের লিপে গান গাওয়ার অনুসন্ধানেই জন্ম হল কিশোরকুমারের। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭০ সাল গায়ক হিসাবে কিশোরকুমারের স্বর্ণযুগ।

সে সময় তাঁর একের পর এক গান হিট হয়েছিল। সেই সময়কার বিখ্যাত প্রায় সব গীতিকারের কথায় , সুরকারের সুরে গান গেয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন কিশোরকুমার। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি যে গুলিতে তিনি কণ্ঠ দিয়ে গান হিট করেছিলেন – আনন্দ আশ্রম, আরাধনা, অমানুষ, ট্যাক্সি ড্রাইভার, মুনিমজী, পেয়িং গেস্ট, প্রেম পূজারী, চলতিকা নাম গাড়ি, আশা, গাইড, জুয়েল থিফ, শোলে……।

বলাবাহুল্য, এই সময়ে তাঁর সাথে রাহুল দেববর্মনের জুটি সফল হয়েছিল দারুণভাবে। রাহুল দেববর্মনের নব্বই শতাংশ গানই গেয়েছিলেন কিশোরকুমার। কলকাতায় শেষবারের মত এসেছিলেন ১৯৮৭ সালে। স্টেডিয়ামে লোক উপছে পড়েছিল । ‘গুরু’ ‘গুরু’ রবে ফেটে পড়েছিল পুরো স্টেডিয়াম। সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে কিশোরকুমার বলেছিলেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, আবার আসব। আপনাদের গান শোনাবো।’ সে সুযোগ হয়নি। ওই বছরের ১৩ অক্টোবর তিনি ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন। নইলে তিনি ভারতীয় সঙ্গীতকে আরও সমৃদ্ধ করে যেতেন।

Related Articles