গৌতম গম্ভীরকে আর কত সহ্য করবেন জয় শাহ?
How much longer will Joy Shah tolerate Gautam Gambhir

Truth of Bengal, সুমন ভট্টাচার্য: ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ গৌতম গম্ভীর রাগী লোক। এর আগে যখন তিনি আইপিএল-এ বিভিন্ন দলের মেন্টর ছিলেন, আমরা তাঁকে রাগ করতে দেখেছি। তিনি রেগে মাঠের মধ্যে আরএক ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলির দিকে তেড়ে গিয়েছেন, তিনি রেগে বিভিন্ন সময় ঝগড়ায় জড়িয়েছেন। ওহ! বলতে ভুলে গিয়েছি, গৌতম গম্ভীর যখন আইপিএল-এর মেন্টর হিসেবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বা মাঠের মধ্যে রাগারাগি করতেন, তখন তিনি কেন্দ্রের শাসকদলের হয়ে দিল্লির সাংসদ ছিলেন।
কিন্তু তাতে কী? সাংসদের গরিমা, একজন জনপ্রতিনিধি হওয়ার গুরুত্ব এই সব কিছুকে অতিক্রম করে গৌতম গম্ভীর মাঠের মধ্যে বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়েছেন। তারপরে তিনি সাংসদ পদ ছেড়ে ভারতীয় জাতীয় দলের কোচ হলেন। এবং কোচ হলেন এমন একটা সময়ে যখন রাহুল দ্রাবিড়, যাঁকে ভারতীয় ক্রিকেট ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ বলে চিনত, তিনি ভারতকে টি-টোয়েন্টিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে নিজে বিদায় নিচ্ছেন।
রাহুল দ্রাবিড়কে কেউ কোনওদিন মাথা গরম করতে দেখেননি। তিনি যখন ক্রিকেটার ছিলেন, তখনও নয়।তিনি যখন কোচ হিসেবে ভারতীয় দলের সঙ্গে ছিলেন, তখনও নয়। কিন্তু গৌতম গম্ভীর মানেই আলাদা বিষয়। তিনি ‘অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান’, তিনি মাঠের মধ্যে তেড়ে যান, তিনি সাংসদ হিসেবে দিল্লির আপ নেত্রী আতিশীর সম্পর্কে কুকথা বলেন। এটা আলাদা বিষয়, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পদত্যাগের পরে সেই আপ নেত্রী আতিশীই এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী।
হঠাৎ গৌতম গম্ভীরকে নিয়ে আলোচনা করছি কেন? কারণ, কোচ হিসেবে গৌতম গম্ভীর ভারতীয় ক্রিকেটকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন, যে ক্রিকেটপ্রেমীরা লজ্জায় মাথা হেঁট করে বসে আছেন। নিউজিল্যান্ড টেস্ট ক্রিকেটে ভারতবর্ষকে ভারতের মাটিতে ৩-০-তে হারিয়েছে। অর্থাৎ টেস্ট সিরিজের তিনটে টেস্ট-এর মধ্যে তিনটেতেই ভারত হেরেছে। গত কয়েক দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের এরকম অবস্থা কখনও হয়নি, তাও আবার দেশের মাটিতে।
গৌতম গম্ভীর এই নিয়ে খুব চিন্তিত না হলেও ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা যথেষ্টই লজ্জিত। নিউজিল্যান্ডের কাছে সিরিজে ‘হোয়াইট ওয়াশ’ হওয়া শুধু নয়, এর আগে ভারতীয় ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কাতে গিয়েও হেরেছে। প্রশ্ন উঠছেই, তাহলে গৌতম গম্ভীরের ‘পারফরম্যান্স’ কোথায়? আমাদের মনে রাখতে হবে, যে গৌতম গম্ভীর কোচ হওয়ার পর তিনি যা চেয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেট কর্তারা তাঁকে তাই দিয়েছেন।
আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, ভারতীয় ক্রিকেট সংস্থার সর্বময় কর্তা জয় শাহ, ভারতের মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ‘সুযোগ্য পুত্র’ বিজেপির এই প্রাক্তন সাংসদের যাবতীয় দাবি মেনে নিয়েছেন। বোলিং কোচ হিসেবে গৌতম গম্ভীর জাহির খানকে চাননি, জয় শাহ তাঁকে জাহির খানকে দেনওনি।
তিনি গৌতম গম্ভীর, যিনি একসময় সওয়াল করতেন যে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ বা সাপোর্ট স্টাফদের ভারতীয়ই হওয়া উচিত, তিনি জোগাড় করে এনেছেন যাবতীয় বিদেশিদের! তাও জয় শাহ মেনে নিয়েছেন। হাজার হোক তাঁর বাবার দলের ‘প্রাক্তন সাংসদ’ বলে কথা! তারপরেও ‘অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান’ গৌতম গম্ভীর! তাঁর সব আবদার না মানলে চলবে কী করে? কিন্তু জয় শাহ যাবতীয় আবদার মানার পরেও গৌতম গম্ভীরের ‘পারফরম্যান্স শূন্য’। শূন্য ভুল বললাম, দেশের মাঠে বিদেশিদের কাছে টেস্ট সিরিজে চুনকাম হওয়া আসলে পারফরম্যান্স হিসেবে ‘মাইনাস’।
ক্রিকেট ভারতের জাতীয় আবেগ। ভুল বললাম, আসলে ধর্ম। সেই ১৯৮৩-তে কপিল দেব ভারতবর্ষকে প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপে জয়ী করার পর থেকে ক্রিকেট আমাদের অস্থিতে, মজ্জায়, রক্তে ঢুকে গিয়েছে। এতটাই ঢুকে গিয়েছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের স্টেডিয়ামে চলে গিয়েছিলেন ভারত ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জিতবে এই প্রত্যাশায়। সেটা অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়।কারণ, ক্রিকেট আমাদের আবেগ, ক্রিকেট আমাদের ধর্ম, ক্রিকেটে হারলে আমরা কাঁদি, জিতলে আমরা আনন্দে পাগল হয়ে যাই, রাস্তায় মিছিল বের করি।
কিন্তু, গৌতম গম্ভীর আজকের ভারতীয় ক্রিকেটকে গত কয়েক মাসে যেখানে নিয়ে গিয়েছেন, সেখানে ক্রিকেট ভক্তরা হতোদ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়।এবং কেউই বুঝতে পারছেন না হঠাৎ হলটা কী ভারতীয় ক্রিকেট দলের। আড়ালে-আবডালে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে গৌতম গম্ভীর এমন ‘নিয়ন্ত্রণ’ চালু করেছেন, যে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অবস্থা এমনটাই হওয়ার ছিল। তিনি কারও বারণ না শুনে ঘরের মাঠে ঘূর্ণি পিচ করেছেন।
আর সেই ঘূর্ণি পিচে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা নাস্তানাবুদ হয়েছেন এবং বিদেশিরা উইকেট তুলে নিয়ে গিয়েছেন। এই অবিবেচক সিদ্ধান্তের কারণ কী? কেউ গৌতম গম্ভীরকে প্রশ্ন করার জন্য নেই। কারণ, গৌতম গম্ভীর জয় শাহের ‘আশীর্বাদধন্য’। ফলে তিনি যেমন খুশি করেছেন, এবং তেমন খুশি দলকে ডুবিয়েছেন। সমস্যা হচ্ছে আজকের ভারতবর্ষে ক্রিকেট নিয়ে যদি গৌতম গম্ভীরকে কেউ সমালোচনাও করে, তাহলে গেরুয়া শিবির তার দিকে রে রে করে তেড়ে যাবে।
কিন্তু সাধারণ ক্রিকেট ভক্তরা জানতে চাইবেন না যে গৌতম গম্ভীর, যিনি বিজেপির সাংসদ পদ ছেড়ে জাতীয় দলের কোচ হয়েছিলেন, তাঁর পারফরম্যান্স কবে নিক্তির ওজনে মাপা হবে? শ্রীলঙ্কাতে গিয়ে শ্রীলঙ্কার কাছে আমরা হেরেছি, ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড আমাদের ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করেছে। এবং তারপরেও গৌতম গম্ভীরের নিত্যনতুন আবদার বন্ধ হচ্ছে না। তিনি জাতীয় ক্রিকেট দলের চার মহাতারকা, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, রবীন্দ্র জাদেজা এবং মহম্মদ শামিকে ছেঁটে ফেলতে চান।
তিনি মনে করেন, যে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি না জিতলে এঁদের আগামী বিশ্বকাপের জন্য আর দলে রাখা যাবে না। আচ্ছা, গৌতম গম্ভীরকে মনে রাখতেই হবে, যে বাকি সকলে না হয় বিজেপির কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু রবীন্দ্র জাদেজা গুজরাটে বিজেপিই করেন, তাঁর স্ত্রী বিজেপির হয়ে নির্বাচনেও লড়েছেন। তা সত্ত্বেও গৌতম গম্ভীর যে একাধিপত্য কায়েম করতে চান, সেখানে রবীন্দ্র জাদেজারও স্থান নেই। ক্রিকেটে, রাজনীতিতে বা জীবনের যে কোনও অধ্যায়ে একাধিপত্য কায়েম করা যায়, যদি আপনার ‘পারফরম্যান্স’ থাকে। কিন্তু গৌতম গম্ভীরের ‘পারফরম্যান্স’ তো ‘শূন্য’।
তিনি কোনওদিনই ক্রিকেটের মহাতারকা নন। শচীন তেন্ডুলকর বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়দের সময় তিনি নিতান্তই ‘সাইড অ্যাক্টর’ ছিলেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি যখন ছয় মেরে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন, তখনও ধোনির ‘তারকা স্ট্যাটাস’ নিয়ে প্রশ্ন করে গৌতম গম্ভীর বলেছিলেন, “শুধু কি একটা ছয় মেরে বিশ্বকাপ জেতানো যায়?” নিশ্চয়ই জেতানো যায় না, কিন্তু এই যে সহ-খেলোয়াড়ের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণতা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত সমালোচনা, এটাই গৌতম গম্ভীরের চরিত্র।
এমনিতে খেলাধুলোর ময়দানে রাজনীতি থাকবেই। পশ্চিমবঙ্গের হেরে যাওয়া বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবে শাসকদলের আশীর্বাদে ভারতীয় ফুটবল সংস্থার সভাপতি হয়েছেন। ভারতীয় ফুটবল দলের কী অবস্থা, কল্যাণ চৌবে তাকে কতটা এগিয়ে দিতে পারলেন সে নিয়ে আলোচনা করে কিছু লাভ নেই।কারণ, ফুটবল ভক্তরাও জানেন ভারতীয় ফুটবল বর্তমানে ঠিক কোথায়। বিজেপির আর এক বিতর্কিত সাংসদ ব্রিজভূষণ ভারতীয় কুস্তিকে কোথায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন, কেন পদক জেতা কুস্তিগিরদের রাস্তায় বসে আন্দোলন করতে হয়েছিল, সেই নিয়েও আলোচনায় ঢুকছি না।
কারণ ব্রিজভূষণকে সরালেও তাঁর পুত্রই এখনও কুস্তির কর্তা। আর প্রতিবাদী কুস্তিগিররা রাজনীতিতে চলে গিয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেট আমাদের ধর্ম, আমাদের আবেগ, তার কী হবে? জয় শাহ ভারতের ক্রিকেট সংস্থার ‘অবিসংবাদিত কর্তা’, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র, তিনি কি ভাববেন গৌতম গম্ভীর ভারতীয় ক্রিকেটকে নিয়ে যে ‘ছেলেখেলা’টা খেলছেন, এবার তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে?
গৌতম গম্ভীর কোচ হিসেবে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, রবীন্দ্র জাদেজা, মহম্মদ শামিকে বাদ দিয়ে দিতেই পারেন, যদি তিনি ‘পারফরম্যান্স’ করতে পারতেন। তিনি আইপিএল-এ কেকেআর-এর মেন্টর ছিলেন, সেই সময় কেকেআর আইপিএল জিতেছে। তিনি দিল্লি ডেয়ারডেভিলস-এরও কিছু দিন মেন্টর ছিলেন।
কিন্তু আইপিএল আর ভারতীয় দলের কোচ হওয়াটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বিশেষ করে যেখানে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে টেস্টও খেলতে হচ্ছে, টি-টোয়েন্টিও খেলতে হচ্ছে আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটও খেলতে হচ্ছে। গৌতম গম্ভীর কি সত্যিই এতটা ‘প্রতিভাশালী’, যে এই সব ধরনের ক্রিকেটে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘পারফরম্যান্স’ এনে দেবেন?