দোলপূর্ণিমা শুধু বসন্তের রঙিন উদযাপন নয়, পালিত হয় শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি হিসেবেও
Dola Purnima is not only a colorful celebration of spring, but is also celebrated as the birth anniversary of Sri Chaitanya.

Truth Of Bengal: সঞ্চালী রায়: দোলযাত্রা, যা বাংলার অন্যতম প্রাচীন উৎসব, বসন্তের আগমনী বার্তা বহন করে। এটি শুধু রঙের উৎসব নয়, বরং এক ঐতিহ্য, যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে বৈষ্ণব ধর্ম, পৌরাণিক কাহিনি এবং সংস্কৃতির গভীরে। যদিও অনেকেই দোল ও হোলিকে এক মনে করেন, তবে প্রকৃতপক্ষে এই দুটি উৎসব আলাদা। দোলযাত্রা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ, যেখানে হোলি মূলত অবাঙালিদের উৎসব। দোলপূর্ণিমার দিনটি শুধু বসন্তের রঙিন উদযাপন নয়, এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাধা ও গোপীদের সঙ্গে রঙ খেলার স্মরণে পালিত হয় এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
দোলযাত্রার উৎপত্তি ও নামকরণ— ‘যাত্রা’ শব্দের অর্থ গমন বা চলন। কোনও দেবতার বিশেষ সময়ে গমন এবং তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে সমাবেশ হলে তাকে ‘যাত্রা’ বলা হয়। যেমন রথযাত্রা, স্নানযাত্রা ইত্যাদি। একইভাবে, দোলপূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবীর ও গুলাল নিয়ে রাধা ও গোপীদের সঙ্গে রঙের খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোলযাত্রার সূচনা হয়। এই দিনটিকে গৌরপূর্ণিমা বলেও অভিহিত করা হয়, কারণ ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি, দোলপূর্ণিমার দিনেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল। শ্রীচৈতন্য ছিলেন ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং কৃষ্ণভক্তির প্রচারক। তাঁর জন্মতিথি হওয়ায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এই দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পুরাণ ও ইতিহাসের দৃষ্টিতে দোলযাত্রা–
১. শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রেমলীলা– পুরাণ মতে, ব্রজভূমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসন্তের দিনে রাধা ও গোপীদের সঙ্গে রঙের খেলায় মেতে উঠতেন। এই খেলায় গোপীরা শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দিতেন, যা পরে দোল উৎসবের রূপ নেয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার প্রতিচ্ছবি আজও মথুরা ও বৃন্দাবনে হোলি উৎসবে দেখা যায়, যেখানে ষোল দিন ধরে হোলি উদযাপিত হয়।
২. প্রহ্লাদ ও হোলিকার কাহিনি– হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুভক্ত পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যার জন্য নানা পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি তাঁর বোন হোলিকাকে আদেশ দেন প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করতে, কারণ হোলিকার বর ছিল যে আগুন তাকে পোড়াতে পারবে না। কিন্তু প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর আশীর্বাদধন্য, ফলে আগুনে হোলিকা পুড়ে যায়, আর প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে হোলিকার আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে দোলের আগের দিন ‘বুড়ির ঘর পোড়ানো’ হয়, যা অশুভ শক্তির বিনাশ এবং শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক।
দোলযাত্রার উল্লেখ শাস্ত্রে ও সাহিত্যে–
১. জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা সূত্রে রঙ ও গুলাল নিয়ে মহোৎসবের কথা আছে।
২. ভবভূতির ‘মালতী-মাধব’ নাটকে বসন্ত উৎসবের বর্ণনা আছে।
৩. সম্রাট হর্ষবর্ধনের লেখা ‘রত্নাবলী’ নাটকে হোলিখেলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
৪. কালিদাসের ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে বসন্ত উৎসবের বর্ণনায় যুবতীরা কুসুম রস, কৃষ্ণচন্দন ও কুঙ্কুম মিশ্রিত রঙে নিজেদের রঞ্জিত করত।
৫. আরব পর্যটক আলবেরুণীর লেখাতেও ভারতবর্ষের হোলি উৎসবের কথা আছে। এছাড়াও, দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরের হাম্পির মন্দিরে এক রাজকুমার ও রাজকুমারীর হোলিখেলার দৃশ্য খোদিত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে হোলি বা দোলযাত্রার উৎসব বহু প্রাচীন।
ভারত ও বিশ্বে দোল উৎসব– সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের দেশ ভারতবর্ষে রাজ্য বিশেষে দোলযাত্রার ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পাওয়া যায়। যেমন উত্তর প্রদেশের মথুরা থেকে ২৭ বারসানা গ্রামে লাঠমার হোলি উদযাপিত হয় যেখানে গ্রামের মহিলারা লাঠি নিয়ে পুরুষদের প্রতীকী তাড়া করেন যা লোককথা মতে শ্রী কৃষ্ণের সময় থেকে চলে আসছে। গোয়ার ছবি আর একটু আলাদা! এখানে বসন্ত উৎসব ধাকতে শিগমো ও ভাদলো শিগমো নামে পরিচিত, যার পুরোভাগে থাকেন মূলত শ্রমজীবী মানুষ। উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুরে আবার পাঁচদিন যাবৎ পালিত হয় ইয়োসাং উৎসব যা দোলযাত্রার নামান্তর।
এইসব উৎসব মধ্য যুগেও সমান জনপ্রিয় ছিল। যার প্রভাব জাত, ধর্ম বর্ণের ব্যবধান বহুলাংশে দূর করে দেয়। ঐতিহাসিক দলিল ঘাঁটলে দেখা যায় মোঘল সম্রাট শাহজাহান দোলযাত্রার নামকরণ করেছিলেন ঈদ-এ-গুলাবি, যার মিনিয়েচার ছবি দিল্লির জাতীয় সংগ্রহালয়ে সহজেই দেখা যায়।
বাংলায় দোল উৎসব ও শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব– বাংলায় দোল উৎসবের প্রচলন মূলত শ্রীচৈতন্যদেব দ্বারা। ১৫১৫ সালে তিনি পুরীধাম থেকে বৃন্দাবনে গিয়ে সেখানে রঙ খেলার সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হন এবং বাংলায় এই উৎসবের প্রচলন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উৎসবকে নতুন মাত্রা দেন।
১৯২০ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের সূচনা করেন। এখানে দোলপূর্ণিমার দিন ছাত্র-ছাত্রীরা বসন্তের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নেয় এবং নৃত্য, সংগীত, কবিতা ও আবৃত্তির মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে।
দোলযাত্রা কেবল রঙের খেলা নয়, এটি প্রেম, ভক্তি, শুভ শক্তির জয়, ও বসন্তের উদযাপন। রাধাকৃষ্ণের লীলা, শ্রীচৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন, হোলিকার আত্মত্যাগ— সব মিলিয়ে দোল এক অনন্য সাংস্কৃতিক উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই দিন মানুষ এক হয়ে যায়, ভুলে যায় বিভেদ, শুধু রঙে রঙিন হওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। দোলপূর্ণিমার এই রঙিন উৎসব তাই শুধু আচার-অনুষ্ঠানের নয়, বরং এটি ভালবাসার প্রতীক, যা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।