
Truth Of Bengal: আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর (২০২৪) বইমেলায় ২৭ লক্ষ বইপ্রেমীর আবির্ভাব হয়েছিল। আর বিক্রিত বইয়ের পরিমান দাঁড়িয়েছিল ২৭ কোটি। যতই প্রযুক্তির উন্নতি ঘটুক বই-ই কিন্তু বলে শেষ কথা। উন্নত প্রযুক্তির সাথে সাথে বই পড়া চলছেই। বলা যায় আগেও বই পড়ার আগ্রহ মানুষের ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। অর্থাৎ, বই মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে। প্রকৃত বই একটা আদর্শ পাঠককে খুঁজে নিতে সাহায্য করে।
বইয়ের গুরুত্বের কথা ভেবে লিও টলষ্টয় একসময়ে বলেছিলেন ‘জীবনে আমার তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই। আবার বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন দুঃখ করে বলেছিলেন ‘জ্ঞান সমুদ্রের তীরে তিনি কেবলমাত্র নুড়ি কুড়িয়েছেন।’ পন্ডিত বিদ্যাসাগর ও পরমজ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দ যখন পড়াশোনার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তখন ভাবলে বিস্ময় জাগে কী তীব্র ছিল তাঁদের জ্ঞান-পিপাসা। বই ছিল তাঁদের সর্বক্ষনের সঙ্গী, সময় অসময়ের বন্ধু। বই ছাড়া তাঁরা নিজেদের কথা ভাবতেই পারতেন না। বই ছিল তাঁদের কাছে।
হাতিয়ার বিশেষ এরই সাহায্যে তাঁরা জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন, নিজেদের ঋদ্ধ করেছেন। কৈশোরে পড়ার সুযোগ না পাওয়ার দুঃখ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভুলেছিলেন পরবর্তী জীবনে বইকে সঙ্গী করে। তাই নিজে মুখেই তিনি বলেছিলেন-‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’ রেঙ্গুনে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র বার্নাড ফ্রি লাইব্রেরিতে বসে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন। সেখানে তিনি ইংরাজি সাহিত্য, সমাজনীতি, রাজনীতি ও দর্শনের বই পড়তেন বলে উল্লেখ করেছেন ব্রহ্মপ্রবাসী লেখক গিরীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর ‘ব্রহ্মদেশে শরৎচন্দ্র’ গ্রন্থে। ১৭৯৮ সালে মিশর অভিযানে নেপোলিয়ানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিল এক জাহাজ বই আর ১৭৫ জন পন্ডিত ব্যাক্তি। তাঁদের সঙ্গে নেপোলিয়ান নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বই ভাবা যায়।
প্রশ্ন করা যেতে পারে কী থাকে একটা বইতে? বরং বলা যেতে পারে কি থাকে না একটা বইতে। দুই মলাটের অন্তর্নিহিত জগতে সাহিত্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, প্রযুক্তি বিদ্যা… ইত্যাদি কত না অনাস্বাদিত বিষয়। বইমেলার দীর্ঘ ইতিহাস বলছে, বছরের পর বছর লেখ ক-প্রকাশকের যুগলবন্দি এমনি ভাবেই সমৃদ্ধ করছে আমাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির জগতকে। কলকাতা বইমেলায় সারা মেলা জুড়েই থাকে নানা বইয়ের সম্ভার। যেখানে অবাধ প্রবেশাধিকার আট থেকে আশি সকলের।
এখানে নানা ভাষার, নানা জাতির • নানা ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটে। পাঠকরা এখানে বই কিনতে অপারগ হলেও খোঁজ পান, সুলুকসন্ধান করতে পারেন অচেনা দেশের কত অজানা জ্ঞানভান্ডারের। উন্নত প্রযুক্তির মানুষেরাও বইমেলার সংস্পর্শে এসে রীতিমত ঘাবড়ে যান হরেক রকমের বইয়ের সস্তার দেখে। ভাবেন সত্যিই এসব দেখছি, না স্বপ্ন। আসলে মেলাটা যে আন্তর্জাতিক। তাই একটা গাম্ভীর্য তো থাকবেই। আছে অবশ্য আন্তরিকতাও। সারা বছরের প্রতীক্ষার পর মেলার প্রাঙ্গন হয়ে ওঠে আকাঙ্খিত এক পুনর্মিলনের জাতীয় আন্তর্জাতিক মঞ্চ। তবে বইমেলায় এমন বহু মানুষ নিয়মিত চোখে পড়বে, যাঁরা আসলে বই কিনতে আসেননি। এসেছেন ঝলমলে উৎসবের মাঠে ফুর্তির মৌতাত নিতে।
১৯৭৬ সালে কলকাতা বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ এর দিল্লি বইমেলা থেকে প্রেরণা খুঁজে নিয়ে। আকারে সেই বইমেলা ছোট হলেও সেই মেলায় বইটাই ছিল মুখ্য। বইয়ের আকর্ষণেই তখন
বইমেলায় ছুটে যেতেন বই প্রেমীরা। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের তখন এত রমরমা ছিল না। আজকে প্রযুক্তির উন্নতি হলেও স্রেফ অন্তরের তাগিদে বইপ্রেমী বাঙালির উৎসাহে কোন ভাটা পড়েনি। বইমেলা তাই প্রকৃত অর্থেই বলা যেতে পারে বই পার্বন’। সারাবছরই বইপ্রেমীরা অপেক্ষায় থাকেন কবে আসবে সেই ঝলমলে সংস্কৃতি আর মননের উৎসব। ‘বইমেলা দুয়ারে আসা মানেই মনের ঢাকে কাঠি। বই উৎসব, বই পার্বন যেভাবেই একে আখ্যায়িত করা হোক না কেন আসলে সবই সেই বইকে ঘিরে।
দেখতে দেখতে এসে গেল ২০২৫ এর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। ৪৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বইমেলার ফোকাল থিম কান্ট্রি হিসেবে অংশগ্রহণ করছে জার্মানি। প্রতি বছরের মত অংশগ্রহণ করছে অন্যান্য দেশ গুলিও। বরাবরের মত এবারেও লিটল ম্যাগাজিনের স্টল এবং শিশুদের প্যাভিলিয়নের ব্যবস্থা থাকবে।
পরিশেষে বলা যায়, কলকাতা বইমেলা দিনকে দিন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অনুপ্রেরণায়। উনি নিজে যে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। তাই বোধহয় বইমেলার প্রতি এত টান ওনার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের লেখা অনেক বই বইমেলায় স্থান পায়। যা সত্যিই আমাদের কাছে গর্ব ও অহঙ্কারের। (লেখক: বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)