
Truth of Bengal, অনন্যা ভট্টাচার্য: ছ’টা ছয়ের ডানকুনি লোকাল শিয়ালদা স্টেশন ছাড়বে ছাড়বে করছে। কলেজ এবং অফিস ফিরতি মানুষের ভিড় গিজগিজ করছে কম্পার্টমেন্ট জুড়ে। প্ল্যাটফর্মে বগির সামনে কয়েকটি ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে খোশ মেজাজে গল্প করছে। ট্রেনে ওঠার তাগিদ নেই। সুতরাং ধরে নেওয়াই যায় এরা এই ট্রেনে উঠবেনা। মহিলা কম্পার্টমেন্ট মোটামুটি ভিড়ে ঠাসা। তারমধ্যেই ঝালমুড়ি, ঘুগনি, পেয়ারা, দুল সবই বেচা কেনা চলছে।
বেশ একটা মধ্যবিত্ত দিনের গোধূলিকালীন চিত্র ছড়িয়ে রয়েছে ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট জুড়ে। সময় মতো ট্রেন তার বাঁশি বাজিয়ে দিল, ধীরে ধীরে দুলে উঠল ট্রেন। চলতে শুরু করল প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে। এই পর্যন্ত দৃশ্যটা সবার ভীষণ চেনা কিন্তু ঘটনাটা শুরু হল ঠিক এরপরেই। যেক’জন ছেলে মেয়ে প্ল্যাটফর্মে আড্ডা মারছিল খোশ মেজাজে, হঠাৎ তারা দৌড়তে শুরু করল এবং প্রতিযোগিতার ছলে চলন্ত ট্রেনের বগিতে নিপুণ পদ্ধতিতে লাফিয়ে উঠে পড়ল।
ট্রেনের মধ্যে থাকা যাত্রীরা হইচই করে উঠলেন। একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা শাসনের ভঙ্গিতে বলতে গেলেন এটা করা উচিত নয়। কিন্তু তার উত্তরে ভেসে এল অশ্রাব্য কটু বাক্য। যেন তারা এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এই ঘটনাটি চলল বিধাননগর স্টেশন আসা অবধি এবং স্টেশন এসে গেলে তারা একই রকম হইচই করতে করতে নেমে গেল।
এই ঘটনার থেকে দুটি জিনিস সুষ্পষ্ট হয় সেদিন। প্রথমত, এদের জীবনে পর্যাপ্ত পরিমাণে সময়কে ব্যয় করার অভাব তাই তাদের অর্থহীন উত্তেজনার প্রতি এত টান। দ্বিতীয়ত, অন্যকে মৌখিক হেনস্থা করার প্রতি তাদের তীব্র টান। এই ঘটনা দুটিতে আর একটু আলোকপাত করা যাক।
কৈশোর থেকে সদ্য প্রাপ্তবয়স্কদের দলে পা দেওয়া ছেলে মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিশাহীন থাকে। একদিকে সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার তীব্র উচ্ছ্বাস। যে সমস্ত বিধি নিষেধের বেড়াজাল সমাজের তরফ থেকে তাদের চারপাশে ছিল সেগুলিকে ভেঙে ফেলার এক অমোঘ আনন্দ। অন্যদিকে সমাজের নিয়ম কানুনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যোগ্য জবাব দেওয়ার তাগিদ। তাই সদ্য প্রাপ্তবয়স্করা অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে কেন এরকম করছে এরা? সাধারণত বাবা-মায়েরা এসে অভিযোগ করেন যে আমাদের সময় তো এরকম আমরা করতাম না অথবা আমরা এই শিক্ষা দিয়ে তো মানুষ করিনি। একদম সঠিক কথা। কোনও মা-বাবা তাঁর সন্তানকে কুশিক্ষা দিয়ে বড় করেন না। কিন্তু তারপরেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ দুটো ভাগে বিভক্ত।
প্রথমত সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা তাদের কৈশোরকালীন জীবনকালে সমাজকে কী ভাবে দেখছে সেটা ভীষণ জরুরি। সমাজ বলতে শুধু যে দেশের অবস্থান তা কিন্তু নয়। একটি বাচ্চার সমাজ সম্পর্কে ধারণা শুরু হয় তার চারপাশের পরিবেশ থেকে। ধীরে ধীরে তারা সেই জানালা দিয়ে প্রত্যক্ষ করে তাদের চারপাশ। অর্থাৎ যে শিশুটি হলুদ চশমা চোখে দিয়ে আকাশ দেখতে শিখল তার আকাশকে চেনার রং কখনও নীল হতে পারেনা।
সুতরাং শুরুর থেকেই সে জেনে আসছে আকাশের রং হালকা সবুজ। এমতাবস্থায় আঁকার খাতায় যদি আকাশের রং সবুজ করে সেই বাচ্চাটি এবং আমরা তার প্রতিবাদ করি তখন নীল রং আকাশের হয় এই তথ্যকে হয় সে জোর করে মেনে নেবে। যার ফল স্বরূপ অবদমিত রাগের উৎপত্তি হবে। যেটা তাকে পরবর্তীতে অন্যের প্রতি মৌখিক বা দৈহিক আগ্রাসনের দিকে ঠেলে দেবে। কিংবা সে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করবে এবং তার অবুঝ মনের অবাধ্য রাগ বেরিয়ে পড়বে।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় কারণে। বাবা-মায়েরা সন্তানকে শিক্ষা দিতে গিয়ে শিশুর সুকুমারী সত্তাকে কোথাও আহত করছেন। জীবনের ইঁদুরদৌড়, অন্যের সঙ্গেতুলনা, শিশুদের আত্মসম্মানবোধকে আহত করা– এমন কিছু ব্যবহার করা বাচ্চার সামনে যা তাদের জীবনবোধের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে।
কৈশোরকালীন সময়ে সন্তান অনেক প্রশ্ন করে বা সমাজের ধারণার বিরোধ করে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ধারণাগুলিকে অবদমিত না করে যদি আলোচনা করা যায় তাহলে একটা মধ্যবর্তী পথে সমাজকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায় সদ্য প্রাপ্তবয়স্করা। জীবনের সুকুমারী প্রবৃত্তিগুলি যদি তারা অন্বেষণ করে বিশ্লেষণ করতে পারে তাহলে ভবিষ্যতের এই ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ম ভাঙার খেলায় তাদের নামতে হয়না।
তাহলে এই ঘটনার শেষ কোথায়? কাঠগড়ায় আমরা খুব সহজে সবাইকে তুলে দিতে পারি কিন্তু কখনও এটা ভাবিনা এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাণশিল্পী কিন্তু আমরা নিজেরাই। যে নিয়ম ভাঙার খেলায় এখনকার প্রজন্মের অনেকেই মেতেছে, তার দায় কিন্তু আমাদেরই। যে প্রত্যক্ষণ দিয়ে তারা সমাজকে দেখছে তার বুনিয়াদ আমরাই তৈরি করেছি।
এই প্রজন্মের চোখে উদ্ভাবনের হাতছানি আছে ঠিকই। কিন্তু বাবা-মা, শিক্ষক বা অভিভাবক হিসাবে ঐতিহ্যের প্রতি, অতীতের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং আস্থাশীল হতে শেখানোর দায় কিন্তু আমাদেরই। মনে রাখতে হবে ইতিহাসের থেকে বড় বিজ্ঞানের ভাণ্ডার আর কোথাও রাখা নেই। তাই নিয়ম ভাঙতে গেলে নিয়ম মানতে হবে আগে।