খালিস্তানি আন্দোলনের এক মুছে যাওয়া অধ্যায়, ফিরে দেখা ইতিহাস
তিনি ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে নিজের কাছে টানেন এবং অকালি দলকে পর্যুদস্ত করার এক প্ল্যান তৈরি করেন

The Truth of Bengal: পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি- একটা সময় ছিল, যখন ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পঞ্জাব। তাই যদি হবে তাহলে, কী এমন ঘটেছিল, যে পঞ্জাবের যুবসমাজ আচমকা অস্ত্র হাতে তুলে নিল? কেন একটা দেশের মধ্যে আলাদা দেশের আওয়াজ উঠল? এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু হল?
সময়টা সাতের দশক, পঞ্জাবের ইতিহাসে এক অন্ধকার সময় নেমে আসে। ১৯৭৭ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পার্টি পুরো মুখ থুবড়ে পড়ে। এমনকী পঞ্জাব বিধানসভাতেও কংগ্রেসের বিপর্যয় নেমে আসে। ফলে, দেশের পাশাপাশি পঞ্জাবেও ক্ষমতাচ্যুত হয় কংগ্রেস।
পঞ্জাবে প্রকাশসিং বাদলের নেতৃত্বে আকালি দল সরকার গঠন করে। আর সেই সময় কংগ্রেস এমন এক ব্যক্তিত্বের সাহায্য নেওয়া শুরু করে, যার জন্য সাত বছরের মধ্যে শুধু পাঞ্জাবই নয়, গোটা দেশেই তোলপাড় পড়ে যায়। তাঁর নাম জার্নেল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে।
জার্নেল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে। অমৃতসরের একজন উঠতি স্বঘোষিত ধর্মগুরু, সে রাজনীতিতে মাথা গলায় জ্ঞানী জৈল সিং এবং সঞ্জয় গান্ধীর হাত ধরে। সেই সময় জ্ঞানী জৈল সিং ছিলেন পঞ্জাবের একজন বড় নেতা। তিনি ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে নিজের কাছে টানেন এবং অকালি দলকে পর্যুদস্ত করার এক প্ল্যান তৈরি করেন। ঠিক হয়, তাঁদের হয়ে পঞ্জাবে নতুন ঝড় তৈরি করবে, জার্নেল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে। এমনকী এই নীল নক্সা পাকাপোক্ত করতে ভিন্ড্রাওয়ালের সঙ্গে দিল্লিতে বৈঠকও বসে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের।
জার্নেল সিং ভিনড্রাওয়ালে হাবভাব চালচলন প্রথম থেকেই ছিল রাফ অ্যান্ড টাফ। ১৯৭৮ সালের ১৩ এপ্রিল। নিরঙ্কারি এবং অমৃতধারী শিখদের মধ্যে ব্যাপক গণ্ডগোল বাঁধে। ভয়ঙ্কর খুনখারাপিও হয়। সেই সময়ই থেকেই ভিন্ড্রাওয়ালের নাম প্রকাশ্যে আসে। এই দিন ১৩জন অমৃতধারী শিখ মারা গিয়েছিলেন।
এরপরেই শিখ সম্প্রদায়ের এক শাখা নিরঙ্কারি বাবা গুরবচন সিংয়ের বিরুদ্ধে হরিয়ানায় মামলা শুরু হয়। পরে তিনি ছাড়ও পান। আর এখানেই কট্টর শিখরা ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন।
শিখদের ১০ম গুরু গুরুগোবিন্দ সিং নিজেকে শেষ গুরুঘোষণার পর গুরুগন্থ সাহেবকে গুরু বানিয়ে দেন। শিখ পরম্পনার মতে, ওনার পর আর কোনও গুরু নেই। অন্যদিকে নিরঙ্কারি শাখা জীবীত গুরুদের প্রতি আস্থা রাখেন। ১৯৭৮ সালে বাবা গুরবচন সিং নিরঙ্কারিদের প্রধান ছিলেন। পয়লা বৈশাখে দুপক্ষের গণ্ডগোলের পর, ২৪ এপ্রিল গুরবচন সিংকে হত্যা করা হয়। তাঁকে যাঁরা হত্যা করেছিল, তাঁরা ভিন্ড্রাওয়ালের সহযোগী ছিল।
আসলে সেই সময় কংগ্রেস অনেক হিসেব নিকেশ করে ভিন্ড্রাওয়ালেকে সামনে তুলে আনে। সেই সময় ভিনড্রাওয়ালের প্রচার ও প্রসারের জন্য জ্ঞানী জৈল সিং এবং সঞ্জয় গান্ধী নতুন পার্টিও তৈরি করে দেন। ১৯৮০ সালে ভিন্ড্রাওয়ালে পঞ্জাবের তিন লোকসভা আসনে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন দেয়। তারমধ্যে ছিল অমৃতসরের আসনও। সেই সময় কংগ্রেসের সঙ্গে ভিনড্রাওয়ালের সম্পর্ক কী তা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, তিনি কোনও ভিন্ড্রাওয়ালেকে চেনেন না, কিন্তু তাঁদের এক প্রার্থীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, যদিও সেই প্রার্থীর নাম মনে নেই। ইন্দিরা গান্ধী যে নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল ১৯৮০-র নির্বাচন।
এই নির্বাচনেই ইন্দিরার বিপুল সমর্থন পেয়ে ক্ষমতায় ফেরেন। এই সময়ই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জ্ঞানী জৈল সিংকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জায়গা করে দেন। তারপরেই পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আকালি দলকে পর্যুদস্ত করে। সেই সময় পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হলেন দরবারা সিং। এই সময় থেকেই পঞ্জাবের রাজনীতিতে এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা হয়। পাঞ্জাবে শুরু হয়ে যায়, ভাষা ও ধর্মের নতুন রাজনীতি। আর এর বিরুদ্ধে লাগাতার লেখা শুরু করে লালা জগত নারায়ণ, তিনি একধারে যেমন ছিলেন কংগ্রেস বিধায়ক, তেমনই পঞ্জাবের একমাত্র জনপ্রিয় সংবাদপত্র পঞ্জাব কেশরীর এডিটর। তিনি প্রথম থেকে বলতে থাকেন ভিন্ড্রেওয়ালা নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে, এবং সরকার কিছুই করছে না। আগামী দিনে পঞ্জাবে যে ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি হবে, তারও ইঙ্গিত দিতে থাকেন।
৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮১, পাটিয়ালাতে যখন তিনি নিজের গাড়িতে করে আসছেলিনে। তখন তাঁকে কয়েকজন আততায়ী গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থালেই মারা যায় লালাজগত নারায়ণ। এই ঘটনার চার দিন পরেই ভিন্ড্রাওয়ালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে পঞ্জাব সরকার। মজার ব্যাপার, সেই সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি, বরং হরিয়ানা থেকে সরকারি গাড়ি করে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। অবশেষে চাপের মুখে পড়ে, তার ঠিক দুদিন বাদে গ্রেফতার করা হয়। যদিও কয়েকদিন পরেই ভিন্ড্রাওয়ালেকে জামিন দেওয়া হয়। খবর প্রকাশ পায় ইন্দিরা গান্ধীর হস্পক্ষেতেই সে জামিন পায়। সেই সময় সংসদে এই মুক্তির ব্যাপারে ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্ঞানী জৈল সিং। পাশাপাশি বলা হয়, ভিন্ড্রাওয়ালের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি।
এরপর জার্নেল সিং ভিন্ড্রাওয়ালের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। পঞ্জাবের দাপটও বাড়ে। মুখ্যমন্ত্রী দরবারা সিং আঁচ করতে পারেন, কায়ার থেকে ছায়া বড় হয়ে উঠছে। আর তার প্রমাণ মিলেছিল, খালিস্তানের দাবি থেকেই। পঞ্জাবে এই সময় থেকেই খালিস্তানের পক্ষে জোর সওয়াল করে কংগ্রেস সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ভিন্ড্রাওয়ালে। সেই সময় স্বর্ণ মন্দিরের সামনে ডিআইজি এ এস অটোওয়ালকে হত্যা করা হয়। এবং স্বর্ণমন্দিরের সিঁড়ির সামনে বেশ কয়েক ঘণ্টা পড়ে থাকে তাঁর লাশ। কোনও পুলিশ আধিকারিক তা তোলার সাহস দেখাতে পারেনি। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে দেহ তোলার জন্য ভিন্ড্রাওয়ালের কাছে ফোন যায়। এরপরেই ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করে পুলিশ পাঠানোর অনুমতি চান দরবারা সিং। এদিনে ইন্দিরা গান্ধী জ্ঞানী জৈল সিংয়ের কাছে পরামর্শ চান। জিল সিং স্বর্ণমন্দিরে পুলিশ পাঠাতে বারণ করেন। আর এই ঘটনাতেই ভিন্ড্রাওয়ালে সাহস আরও বাড়তে থাকে। পঞ্জাব সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল হতে থাকে। খুন, লুঠ, ধর্ষণ লাগাতার বাড়তেই থাকে।
এদিকে পঞ্জাবের ছবিটা দিনের পর দিন আরও খারাপ হতে শুরু করে। এই সময়ই ইন্দিরা একটা বড় সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্ঞানী জৈল সিংকে রাষ্ট্রপতি বানানোর পরিকল্পনা করেন। আসলে এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল, শিখ সম্প্রদায়ের একজনকে দেশের সর্বোচ্চ পদে বসালে, শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আগুন ছড়িয়েছিল, তা অনেকটাই কমানো যাবে। কিন্তু এমনটা হয়নি।
জ্ঞানী জৈল সিংয়ের রাষ্ট্রপতি পদে বসার এক মাসের মধ্যে এক শিখ ধর্মগুরুর অপহরণকাণ্ডের পর আকালি দল জোরকদমে ময়দানে নামে। দোষীদের গ্রেফতারির দাবি জানাতে থাকে। দু মাসের মধ্যে ৩০ হাজার গ্রেফতারি হয়। এতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা আরও বিগড়ে যায়।
১৯৮৩ সালে ৫ অক্টোবর। পাঞ্জাবের কাপুরথলা থেকে জলন্ধরের উদ্দেশে একটি বাস যাচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে সেই বাস থামিয়ে বেছে বেছে হিন্দুদের বাইরে বের করে গুলি করা হয়। মৃত্যু হয় ৬ জনের। এই ঘটনার একদিন পরেই, দরবারা সিংকে পদত্যাগ করানো হয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। লাগু করা হয়, রাষ্ট্রপতি শাসন। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৮৩। এই দিনেই ভিন্ড্রাওয়ালে অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখতের দখল নেয়। সেই সময় ভিন্ড্রাওয়ালের পুরো বাহিনী ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। অকাল তখত সিংহাসন মানে, যা অনন্তকালের জন্য তৈরি হয়েছিল। এটি তৈরি হয়েছিল ষোড়শ শতকে। দিল্লির মুঘল দরবারের সিংহাসনের থেকে একফুট উঁচু এই অকাল তখত। অর্থাৎ এই সিংহাসনের ধর্মিক মাহাত্ম্য যেমন রয়েছে, তেমনই রাজনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে।
ভিন্ড্রাওয়ালে স্বর্ণমন্দিরের অকাল তখত দখল নেওয়ার প্রতিবাদ জানান, স্বর্ণমন্দিরের প্রধান গ্রন্থী কৃপাল সিং। কিন্তু ভিন্ড্রাওয়ালে কাউকেই পাত্তা দেয়নি। অকাল তখত থেকেই ভিন্ড্রাওয়ালে ইন্দিরা গান্ধীকে খোলা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। বার্তা দেওয়া হয়, আমরা দেশলাইয়ের কাঠির মতো, যথেষ্ট ঠান্ডা। কিন্তু আগুন লাগালে, তার আঁচে আপনাদেরও পুড়তে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জীবনে উভয়সংকট শুরু হয়। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তার ঠিক ১০ মাস বাদেই লোকসভা ও পঞ্জাবে নির্বাচন। এই সময় ইন্দিরার পক্ষে সমঝোতা করার ছাড়া আর কোনও পথ পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে আকালি দলের নেতারা বুঝে যায়, পাঞ্জাবে ভিন্ড্রাওয়ালে ক্ষমতার দিক থেকে দৈত্য হয়ে উঠেছে। সেই সময়, বিদেশমন্ত্রী নরসিমা রাওকে আকালি দলের সঙ্গে সমঝোতা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমজোতায় রাজি হয় আকালি দলও। কিন্তু এই সমঝোতায় মূল কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় ভিন্ড্রাওয়ালে।
কেন্দ্র, রাজ্য ও ভিন্ড্রাওয়ালের মধ্যে চাপানউতোর বাড়তেই থাকে। ইন্দিরা প্রকাশ্যে আলোচনার ডাকও দেন। কিন্তু পাত্তা দেয়নি ভিন্ড্রাওয়ালে। বরং সেনার এক আধিকারিককে অপহরণও করে নেন। এবং স্বর্ণমন্দিরে কিছু মানুষকে পণবন্দি করে রাখেন। পরিস্থিতি বেগতিক হতে দেখে, ইন্দিরা কঠোর সিদ্ধান্ত নেন। স্বর্ণমন্দিরে সেনা পাঠানোর। শুরু করলেন অপারেশন ব্লু স্টার। তারপর ভারতের বুকে রচিত হয় এক কালো অধ্যায়। সেনা অভিযানে মারা যায় জার্নেল সিং ভিন্ড্রাওয়ালে।
সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের এক অধ্যায় শেষ হলেও, তার ফল হয়েছিল মারাত্ম। খোদ ইন্দিরা গান্ধীকে তার মূল্য চোকাতে হয়েছিল। ইন্দিরার মৃত্যুর পরেও দিল্লিতে যে শিখ দাঙ্গা হয়েছিল, সেটাও আর এক কালো অধ্যায়। একটা সময় পর্যন্ত খালিস্তানি আন্দোলন ভারতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। তার ডালপালা ছড়িয়ে অনেক গভীরে। কারণ ভিন্ড্রাওয়ালের সময়ই, কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপে জাল বিস্তার হয়। সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিদেশের ভূমিকে আধার করে, ফের একবার ভারতের মাটিকে গরম করার চেষ্টা চালাচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এখন প্রশ্ন, তাদের কে ইন্ধন দিচ্ছে? উত্তর হয়তো সময় দেবে।