রাজনীতি

চব্বিশে কি মিথ্যের বিষবৃক্ষের পতন হবে? নাকি ডলপালা ছড়াচ্ছে অন্যপথে!

Expose Stategy of NDA

The Truth of Bengal: কোনও এক কবি এক সময় লিখেছিলেন,

আকাশের মায়ার ছায়া দেখা যায় সাগরের অতলে

বড় মায়াময়, অমৃত লুকিয়ে আছে, রত্নাকরের জলে

দেশে এখন অমৃতকাল চলছে, বড় এক আনন্দ উৎসবের মেজাজ, গোটা দেশ জুড়ে। দেশের জয়জয়কার, গোটা বিশ্বে নাগরিক হিসেবে কাদের না ভালো লাগে! দেশে এগোচ্ছে, অর্থীনীতি, শিল্পে, সংস্কৃতিতে, প্রযুক্তিতে সার্বিক দিক থেকে। কিছু দেশ ঝুঁকে পড়ে ভারতের চরণতলে। এক অদ্ভুত সর্বশক্তিমানের ছবি ফুটে উঠছে পরতে পরতে।

কিন্তু কাহিনি অন্য পথে যখন বাঁক নেয়, তার ধরা পড়ে অন্য দ্বন্দ্ব। স্ক্যাম। আসুন একবার পুরো রেকর্ডের ধুলো ঝেড়ে, ফিরে দেখা যায় ইতিহাসকে। ২০০৪ সাল, দেশে ক্ষমতায় এলো ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স। বাইরে থেকে বামদের সমর্থনে ভালো কাটল পাঁচ বছর। মাঝে কিছু অম্ল মধুর সম্পর্ক হলেও, বিশেষ কোনও আঁচ পড়েনি। কিন্তু কাল হল দ্বিতীয় টার্মে ২০০৯ সালে ফের একবার ক্ষমতায় এলো ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স। এর পরেই শুরু হল নতুন মহাকাব্য। বছর দেড়েক পথ চলার পরেই, ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসলো একের পর এক স্ক্যাম, কেলেঙ্কারি। বিরোধীদের মুহুর্মুহু আক্রমণে বেকায়দায় জোট সরকার।

এই সময়কালে একের পর এক তোপ দাগা হয়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে। কংগ্রেসের অন্দরেও একটা চাপা আতঙ্কের স্রোত বইতে থাকে। এমন এক অদৃশ্য ঝড় যেখানে মনমোহনকে সামনে রেখে বহু বর্ষীয়ান নেতারাও মাথা নুয়ে ফেলেছিলেন। ঠিক যে ভাবে মরুভূমিতে ঝড় উঠলে, অনেকেই মাথা ভাঁজ করে বসে পড়েন।

জোটের নেতারাও পরিস্থিতির সামাল কী ভাবে দেবে তা নিয়ে প্রবল চাপের মুখে। ইউপিএ টু সরকারের সবচেয়ে বড় যে কেলেঙ্কারি দেশের সামনে এসেছিল, তা হল টু জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি। এই দুর্নীতির তদন্তের জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবি, তৎকালীন এনডিএ জোটের নেতারা সংসদে তুলকালাম করেছিল। অবশেষে স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে একের পর এক গ্রেফতারি দেখা যায়। মন্ত্রী এ রাজা, সাংসদ কানিমোঝি থেকে একাধিক সরকারি আমলা ও আধিকারিক। সেই কালো ঘটনার কথা এখনও বিজেপি নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে বলে থাকেন। তারপর গঙ্গার বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। ইউপিএ সরকারের পতন ঘটিয়ে ২০১৪ সালে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। প্রথম পাঁচ বছর ভালোই ছিল। তার ফল মেলে দ্বিতীয় বারে। ২০১৯ সালেও একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ফের ক্ষমতা দখল করে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। কিন্তু প্রথমবারের তুলনায়, দ্বিতীয়বারের এনডিএ-র রূপ যেন একদম ভিন্ন।

গত তিন বছরের রাজনৈতিক কার্যক্রম বলছে, বিজেপি দুর্নীতি প্রসঙ্গে যেন অতিরিক্ত আগ্রাসী। সরকারি এজেন্সিগুলির দাঁত, নখ যেন আগের থেকে অনেক বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই বিরোধীদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এজেন্সিগুলি। আপাতত দৃষ্টিতে এই দৃশ্য অনেকটাই অ্যাকশন সিনেমার মতো মনোরঞ্জনমূলক লাগলেও, সত্যি কি এসবের বাস্তব কোনও সারবত্তা আছে?

না হেঁয়ালি নয়, মিডিয়া ট্রায়ালে অভিযুক্তকে ফাঁসির সাজা শোনানো যায়, এমনকী দিয়েও দেওয়া যায়। কিন্তু বাস্তব কল্পনার থেকেও যে বিচিত্র। এবার আসা যাক একটা আসল সত্যিতে। যে সত্যি লুকিয়ে রয়েছে সময়ের গর্ভে। উদাহরণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাক, স্বাধীন ভারতের সেই বিখ্যাত কেলেঙ্কারি টু জি স্পেকট্রামকেই।  যে কেলেঙ্কারির জেরে বিচারাধীন বন্দি হয়ে জেলে কাটাতে হয়েছিল, মন্ত্রী এ রাজা, ডিএমকে দলের তৎকালীন প্রধান এম করুণানিদির কন্যা কানিমোঝিকেও। সঙ্গে জেলের ভাত খেতে হয়েছিল, একাধিক আমলা ও আধিকারিকদের। আর এর উৎস ছিল ক্যাগ রিপোর্ট। তার ভিত্তিতে জনস্বার্থ মামলা, আর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ কে গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক নির্দেশ।

সময় গড়িয়েছে, এসেছে নতুন সময়। টু জি স্পেকট্রামের যুগ প্রায় শেষ এসেছে ফাইভ জি- কিন্তু কেউ কি মনে রেখেছে, সেই টু জি মামলার জল কতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল? পরবর্তী দেশের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার ভিড়ে সেই মামলা অন্তিম পরিণতি কী হয়েছিল?

আসুন একবার ফিরে দেখি। প্রধান অভিযুক্ত প্রাক্তন টেলিকমমন্ত্রী এ রাজা ২০১২ সাল থেকে জামিনে মুক্ত। কানিমোঝি করুণানিধি, ২০১৭ সালে তাঁকে এই মামলা থেকে বেকসুর কালাস করেছে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত। আমলাদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে একজন সিদ্ধার্থ বড়ুয়া। তাঁকে  ২০১৭ সালে বেকসুর খালাস করে  সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত। আর কে চান্দোলিয়া তাঁকেও ওই সময়ে বেকসুর কালাস করা হয়। বিভিন্ন টেলিকম সংস্থার আধিকারিক সঞ্জয় চন্দ্র, উমাশঙ্কর, গৌতম দোশী, হরি নায়ার, সুরেন্দ্র পিপারা, বিনোদ গোয়েঙ্কা, শাহিদ বালওয়া, আসিফ বালওয়া, রাজীব আগরওয়াল, শরদকুমার, রবি রুইয়াসহ একধিক অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত। ইন্টেরেস্টিং পয়েন্ট হল এই টুজি নামক মহাকাব্যের স্থান, কাল পাত্র নিয়ে। সময়টা ২০১৭ সাল। অর্থাৎ প্রথম এনডিএ-র সময়কাল। সেই সময়ই টু জি স্পেকট্রাম কাণ্ডে যত অভিযুক্ত ধরা পড়েছিলেন, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি সিবিআই। ২০১৮ সালে সেই মামলা অবশ্য উচ্চ আদালতে নিয়ে গিয়েছে ইডি ও সিবিআই। ব্যস এখনও থেমে আছে সেখানেই। বলা ভালো হিমঘরে।

তাহলে নির্যাস কী দাঁড়াল এই মহাকাব্যের? যে কেলেঙ্কারি ভারতের অন্যতম কেলেঙ্কারি বলে আওয়াজ তুলেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। এখনও পর্যন্ত দাঁত, নখ বের করা ইডি সিবিআই তা প্রমাণ করতে পারল না! তাহলে সেই প্রবাদই কি সত্যি করে দেখাচ্ছে কেন্দ্রের শাসকদল? রাজনীতির ময়দানে লড়তে না পেরে, চরিত্রহনন করো।

এখানেই হয়তো আরও একবার কবিতার লাইনগুলি বলতে হয়।

আকাশের মায়ার ছায়া দেখা যায় সাগরের অতলে

বড় মায়াময়, অমৃত লুকিয়ে আছে, রত্নাকরের জলে

অর্থাৎ আসল আকাশ এমন রকম, আর সাগরে অতল থেকে তার রূপ ভিন্ন রকম। সাগরের জলে অমৃত আছে বটে, কিন্তু তা কোন মায়ায় অবগুণ্ঠিত রয়েছে, তা বুঝতে হবে আম জনতাকেই।

Related Articles