সম্পাদকীয়

ওরা সুরে বা তালে নাচে না

They don't dance to the tune or the rhythm.

Truth Of Bengal: জয়দেব দেবাংশী: এই বিশ্ব প্রকৃতিতে সাপেদেরও বেঁচে থাকার  অধিকার আছে। সাপও পরিবেশের একটি বিশেষ অংশ। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের ভূমিকা অনেক। জীবন বিজ্ঞানের বাস্তুতন্ত্র পাঠ্যাংশে খাদ্য, খাদক সম্পর্কিত যে উদাহরণটি সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়, সেখানে অন্য কোনও কিছু না ভেবে সাপ আর ব্যাঙের সম্পর্ক তুলে ধরা  হয়েছে।

তবে এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যাঙ কেন সাপের সঙ্গে ইঁদুরের উদাহরণ দিলেও আশ্চর্যের কিছু থাকত না। প্রতি বছর এই মূষিক সম্প্রদায়ের হাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ও খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। তবে মূষিক সম্প্রদায়ের এখনও যতটুকু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তার একটি বড় কারণ অবশ্যই সাপের উপস্থিতি। এছাড়াও ইঁদুর থেকে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ মহামারিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সাপ।

শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থেই নয়, মানব সমাজের কাছে সাপের ভূমিকা অনেক, সাপের বিষকে কাজে লাগিয়ে এমন কিছু ওষুধ তৈরি হয়, যার কোনও বিকল্প এখনও পর্যন্ত নেই। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় একমাত্র যে অ্যান্টিভেনমের ব্যবহার করা হয় সেটি তৈরি করতে সাপের বিষের প্রয়োজন। হিমোফিলিয়া, বাত, কুষ্ঠ, প্রভৃতি রোগের ওষুধে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এত কিছু পরেও সাপের মৃত্যু সেই মানুষের হাতেই ঘটে থাকে। অথচ কোনও কালেই মানুষের সঙ্গে সাপের শত্রুতা ছিল না। নিজের অনিষ্ঠ না হলে বা আঘাত না পেলে সাপ মানুষকে দংশন করতে আসবে না।

নিজেকে নিজের মতো করে রক্ষা করার অধিকার এই বিশ্বের সবারই আছে। তাই সাপের থেকে ভিন্ন নয়, নিজেকে রক্ষা করতে সাপ তাই অন্যকে দংশন করতে বাধ্য হয়। যদিও ভারতীয় প্রশাসন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বন্যপ্রাণী মারা, ধরা, বিক্রি করা, খেলা দেখানো ইত্যাদি দেশে এখন আইন মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রকৃতপক্ষে সাপ ও একটি বন্যপ্রাণী।

তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রশাসনের এই নির্দেশ সাপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তা সত্ত্বেও দৃষ্টিশক্তির সীমান্তে দেখামাত্রই মানুষ তেড়ে যায় সাপ মারতে। তবে এটাও সত্য প্রতিবছর প্রায় সারা দেশে ২০-২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সাপের দংশনে। বর্ষাকালে এই ঘটনা বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে দেখা যায়। যার ফলে মানুষ ভয়ে সাপকে হত্যা করতে উদ্যত হয়।

প্রায় ২৪ বছর আগে সাপ খেলা দেখাতেন বীরভূম জেলার পাহাড়পুর গ্রামের বিদেশে বাউরি ও মোশান বাউরি। এদের একটি সাপুড়ে দল ছিল। সেই সময় প্রচণ্ড অভাবের তাড়নায় তারা এই সাপুড়ে দলটি তৈরি করেছিলেন। এই দলের সর্দার ছিলেন বিদেশে বাউরি, মশান বাউরি জানালেন, তাঁরা ঝোপঝাড়, জঙ্গল থেকে বিষধর সাপগুলিকে সংগ্রহ করতেন। প্রথমেই তাদের বিষ দাঁত ভেঙে দিতেন।

তারপর রেখে দিতেন বাঁশের ঝাঁপিতে। ছোট ছোট ব্যাঙ ও ছোট ছোট মাছ, খেতে দিতেন। সেই সাপেদের নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বেরিয়ে পড়তেন খেলা দেখাতে। বেশ ভালই রোজকার হতো তখন। ঝাঁপি থেকে সাপ বের করে ডুগডুগি বাজিয়ে গাইতেন ঝাপান গান। সাপ বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করত। দর্শক ভাবতো গানের সুরে সাপ নাচছে, অথচ সাপ আদতে কিছু শুনতে পায়ই না। তাই গান শুনে নাচবে কী করে?

মোশন বাউরি বললেন, একবার তারা শশীধরপুর খেলার মাঠে চরকের মেলায় গিয়েছেন সাপ খেলা দেখাতে। আর সেখানেই ঘটে এক বড় দুর্ঘটনা। সেখানে সর্দার বিদেশে বাউরিকে ছোবল খেতে হয় সাপের কাছে, নিজের   অসাবধানতার জন্য। অনেক ঝাড়ফুঁক করা হল। কিন্তু বিদেশে বাউরি বাঁচলেন না। সেদিনই আমরা দলবল নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম না আর সাপ নিয়ে খেলা দেখাবো না।

বিদেশে বাউরির দেহ সৎকার করে সমস্ত সাপগুলিকে বক্কেশ্বর নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম, মা আমাদের ক্ষমা করো, আর এই সাপগুলিকে রক্ষা করো। বর্তমানে সেই মোশন বাউরি সবাইকে অনুরোধ করেন সাপমারা থেকে বিরত থাকতে।

Related Articles