সম্পাদকীয়

বঞ্চনা ক্রেতা সুরক্ষাতেও! নানা অজুহাতে আটকে টাকা, কেন্দ্রের কাছে পাওনা ৫০০ কোটি

Deprivation of consumer protection too! Money stuck on various pretexts, 500 crores owed to the Center

Truth Of Bengal: বাম জমানায় ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কোনোও গুরুত্ব ছিল না। এই দফতরের কাজ কি, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষ খুব একটা অবহিত ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দফতরের গুরুত্ব বেড়েছে। রক্তের জল করা টাকা দিয়ে সঠিক সময়ে প্রোমোটারের কাছ থেকে সঠিক সময়ে বাড়ি পাচ্ছেন না বা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

বাড়ি পেতে সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন ঘুরতে ঘুরতে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ভেঙে পড়েছে, ক্ষতিপূরণ মিলছে না। ‘সচেতন ক্রেতা, সুরক্ষিত ক্রেতা’, ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের এই স্লোগানকে সামনে রেখে সঠিক বিচার পাওয়ায় ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে আজ হাজারও মানুষ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। আর সমস্যার সত্বর সমাধান হচ্ছে। ডিরেক্টরেট অফ লিগ্যাল মেট্রোলজি ১৯.৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।

একদিকে অভাবনীয় সাফল্য, অন্যদিকে দফতরের গুরুত্ব বাড়লেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ৫০০কোটি পাওনা রয়েছে। নানা অজুহাতে এই টাকা আটকে রেখে দফতরকে বঞ্চনা করা হচ্ছে। আর এই নিয়ে দফতরের বৃহৎ কর্মকাণ্ডের কথা জানালেন রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের মন্ত্রী বিপ্লব মিত্র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি সুবীর মুখোপাধ্যায়।

প্রশ্ন – রাজ্যের মানুষ এই দফতরের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। বেড়েছে এখন অনেক গুরুত্ব। এই জনপ্রিয়তার কারণ কী?

উত্তর- রাজ্যের মানুষ আগে এই দফতর সম্পর্কে জানতই না। আমাদের ২৩টি জেলাতে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কার্যালয় আছে। সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। আর তাই এই দফতরের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। সাধারন মানুষ কোনও প্রতারণার শিকার হলে দ্রত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আগামী দিনেও উপভোক্তাদের পরিষেবা দিতে পারব। সঠিক ওজন, সঠিক গুণমানের জিনিষ না পেলে আমাদের দফতরে সত্বর যোগাযোগ করুন। ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে আপনি অবশ্যই বিচার পাবেন।

প্রশ্ন – কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রয়েছে। কী কারণে এই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না?

উত্তর – কেন্দ্রের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের বকেয়া রয়েছে। এই বকেয়া চেয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও কোনও সদুত্তর দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আমার দফতরের পাওনা রয়েছে। বকেয়া অর্থ না পাওয়ায় অসুবিধা হলেও আমরা উপভক্তদের পরিষেবা দিতে বদ্ধপরিকর। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীকে একাধিকবার দফতরের তরফে এই ব্যাপারে কথা বলা হয়েছে। কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার না হলে সাধারণ উপভক্তাদের কাছে আরও পরিষেবা পৌঁছে দিতে পারতাম।

প্রশ্ন – ডিরেক্টরেট অফ লিগ্যাল মেট্রোলজি এখন অবধি ব্যবসায়ী এবং বাজার থেকে কত রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে?

উত্তর – ডিসেম্বর ২০২৪, সাল অবধি ৫,৪২,৯৫৮ জন ব্যবসায়ী এবং ৪,০৯৯টি বাজার থেকে ১৯.৬৬ কোটি টাকা নন ট্যাক্স রাজস্ব আদায় করতে পেয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ধান সহায়ক কেন্দ্র, ডিরেক্টর অফ এমআর শপ, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে ওজনের সামগ্রীর নজরদারি রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

প্রশ্ন – ক্রেতা সুরক্ষা মেলার উদ্দ্যেশ্য কী?

উত্তর –উপভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে আমরা প্রতি জেলায় তিনটি করে ক্রেতা সুরক্ষা মেলার উদ্যোগ নিয়েছি। আগে জেলায় একটা করে মেলার আয়োজন হতো। এখন জেলাতে তিনটে করে ক্রেতা সুরক্ষা মেলা হবে। এই মেলার মূল উদ্যেশ্য সাধারণ মানুষকে সজাগ করা। ক্রেতা সুরক্ষা দফতর বিভিন্নভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যাতে কোনোওদিন তাদেরকে ঠকতে না হয়। বিক্রেতাদেরও সজাগ করা হয়। উপভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ই-দাখিল পোর্টালের মাধ্যমে রাজ্যে জেলা উপভোক্তা কমিশনে মামলা দাখিল করতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। উপভোক্তা বিরোধী নিষ্পত্তি কমিশন ক্ষতিগ্রস্ত উপভোক্তার বিনা পয়সায় মামলা দায়ের করতে এবং মামলা চালাতে সাহায্য করবে দফতর। আর এর জন্য উপভোক্তা সহায়তা ব্যুরো গঠন করা হয়েছে। কেবলমাত্র আমদের রাজ্যে এই দফতরটি সম্পূর্ণ স্বাধীন দফতর। দেশের অন্য রাজ্যেগুলিতে এই দফতরে সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ এবং ডিরেক্টর অফ মেট্রোলজি দফতরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন- ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়টি স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়ে সরকারের তরফে কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?

উত্তর -পড়ুয়াদের ক্রেতা সুরক্ষা নিয়ে সচেতন করতে আমরা স্কুল কলেজের পাঠক্রমে ক্রেতা সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে আনতে চাইছি। এটি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন -অনলাইনের কেনাকাটা আজকের দিনে বাড়ছে। সাধার মানুষকে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন?

উত্তর -ইন্টারনেট, অনলাইনে যে কোনোও পণ্য আজকের যুগে বাড়িতে বসে সহজেই কেনাকাটা হচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝুঁকিও। কিছু কেনার পর দেখা যায় যে জিনিসটা অর্ডার দেওয়া হয়েছে, সেটা না দিয়ে নিম্নমানের জিনিষ দেওয়া হয়। অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। প্রতারিত কেউ দফতরে যোগাযোগ করলে আমরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। অনলাইনে কেনাকাটার বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।

প্রশ্ন – বাড়ি কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠকতে হচ্ছে অনেক সময়। টাকা দিয়েও সঠিক সময়ে পছন্দনসই বাড়ি না পেয়ে দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এমনকি শহর কলকাতায় বাড়ি ভেঙে পরে গেলে তারা ক্ষতিপূরন প্রমোটাদের কাছ থেকে পাচ্ছেন না।

উত্তর – আমরা এই ব্যাপারে যথাযথ উদ্যেগে গ্রহণ করেছি। সাধারণ মানুষ বাড়ির জন্য টাকা দিয়ে প্রমোটার বাড়ি না দিলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমরা সঠিক বিচার করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হলে আমরা বিনা পয়সায় আইনি সাহায্য দিয়ে থাকি। এই জন্য কোনোও টাকা পয়সা দিতে হবে না।

প্রশ্ন – ক্রেতা সুরক্ষা দফতর জমে থাকা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কোন কি উদ্যোগ নিয়েছে?

উত্তর -এখন ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে মামলার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। আমাদের দফতরের পক্ষ থেকে বেশী সংখ্যক আইনজীবী এবং বিচারকের দাবি করে আসছি। সমস্যাটি দ্রত সমাধান হয়ে যাবে বলে আশাপ্রকাশ করছি। আমরা মনস্থির করেছি সমস্ত মামলা একবছরের মধ্যে শেষ করে ফেলতে হবে। মামলা দিনের পর দিন আর পড়ে থাকবে না।

প্রশ্ন – বর্তমানে রাজ্যে কনজিউমার ক্লাবের সংখ্যা কত? এই ক্লাবগুলির কী ধরনের ভূমিকা রয়েছে?

উত্তর – রাজ্যে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের অধীনে বর্তমানে ১২৩৫টি কনজিউমার ক্লাব আছে। আগামীদিনে এই ক্লাবের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ৩টি স্কুল, ৩০টি কলেজ এবং ১৯টি মাদ্রাসায় নতুন কনজিউমার ক্লাব তৈরী করা হয়েছে। এই ক্লাবের উদ্দ্যেশ্য হল পড়ুয়াদের মাধ্যমে ক্রেতাদের আরও বেশি সচেতন করা যাতে ক্রেতারা প্রতারণার শিকার না হতে পারেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা একজন মেন্টরের মাধ্যমে পড়ুয়াদের সচেতন করবে। এবং তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সজাগ এবং সচেতন করবে।

প্রশ্ন -দফতর সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ডিজিট্যাল প্রচার কর্মসূচি নিয়েছে। কেন এই ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে?

উত্তর -আগে পোস্টার, ব্যানারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা হতো। উপভোক্তাদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে ডিজিট্যাল সচেতনতামূলক প্রচার কর্মসূচির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ৮টি এফএম চ্যানেল, ২৬টি মেট্রো স্টেশনে পাবলিক ডিসপ্লে সিস্টেম মাধ্যমে ৫টি টিভি চ্যানেল এবং একটি কেবল চ্যানেল ও দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে দ্বারা ক্রেতা সুরক্ষা সচেতনতা মূলক প্রচার করা হচ্ছে। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বিভিন্ন ভাষায় সচেতনতা মূলক প্রচার করা হচ্ছে।

প্রশ্ন – এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে?

উত্তর -৩১ডিসেম্বর২০২৪ পর্যন্ত এসসিডিআরসি এবং ডিসিডিআরসি- তে দাখিল হওয়া ২,২০০৯৮৪ টি কেসের মধ্যে ১,৯৭,৪৮০ টি কেস মীমাংসা হয়ে গেছে। লোক আদালতের মাধ্যমে ২৩০টি কেস মীমাংসা করা ।সম্ভব হয়েছে। স্টেট কনজিউমার ডিসপুট রিড্রেসাল কমিশন ৫টি বেঞ্চে, কলকাতায় ৩টি, শিলিগুড়ি এবং আসানসোলে ২টি সার্কিট বেঞ্চ কাজ করছে।এছাড়াও ২৩টি জেলাতে ২৬টি কনজিউমার ডিসপুটস রিড্রেসাল কমিশনস আছে।

প্রশ্ন -একাধিক জেলায় ক্রেতা সুরক্ষা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই কাজের কতটা অগ্রগতি ঘটেছে?

উত্তর -জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমানে সমস্ত দফতরকে একই ছাদের তলায় নিয়ে এসে ক্রেতা সুরক্ষা ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে গেছে। মালদা ভবন নির্মাণের ডিপিআর তৈরী সম্পূর্ণ হয়েছে।

Related Articles