ফিচার

ভূতের ডেরায় সুব্রত ও প্রিয়রঞ্জন…! রাইটার্সের গা ছমছমে গল্প!

Dear Ranjan Dasmunshi and Subrata Mukherjee in the Ghost's Den

Truth Of Bengal: সৌরভ গুহ (সাংবাদিক): লক্ষ্ণৌ শহরের একপ্রান্তে পুরানো দিনের এক হাভেলিতেই রাত কাটানোর ব্যবস্থা হল প্রিয়-সুব্রতর। সাতের দশকে ছাত্র পরিষদের এই মাণিক জোড়কে এই নামেই ডাকতেন কংগ্রেস বৃত্ত ছাড়িয়ে বাংলার আমমহল। সুব্রত রাজ্য রাজনীতিতে ক্রমশ জমিয়ে উঠতে শুরু করলেও প্রিয় পাড়ি জমান সর্বভারতীয় রাজনীতিতে। যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি হিসেবে লক্ষ্ণৌতে সেবার কর্মীসভা করতে এলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। সঙ্গী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের কর্মীসভা মানেই একাধিক গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী মিলিয়ে ঝকমারির একশেষ। সকাল থেকে সম্মেলন আর তারপরই দীর্ঘ নালিশ পর্ব, সঙ্গে একপ্রস্থ সালিশি। বাক্ বিতণ্ডা শেষে হাভেলি’র দিকে পা বাড়াবেন, এমন সময় ছেঁকে ধরলেন এক নাছোড় মহিলা, “মুঝে বহুত কুছ কাহনা হ্যায়। আপকো সুননাহি হোগা।”

সারা দিনের ক্লান্তিতে নুব্জ্য প্রিয়রঞ্জন বললেন “বাদমে সুনলেঙ্গে আভি ছোড়িয়ে” মহিলা জোঁকের মতোই এঁটে আছেন, আপলোগ হাভেলি মে হ্যায় না, আপলোগ আইয়ে, ম্যায়ভি উহাঁ পর আ রাহি হু।”

“আচ্ছা ঠিক হ্যায়”।

কোনও মতে পাশ কাটাবার ছলে বললেন প্রিয় দাসমুন্সী। বলেই সুব্রতকে নিয়ে হনহনিয়ে পা চালালেন হাভেলির দিকে। একঘরেই ঠাঁই হয়েছে দুই নেতার। সারাদিনের ক্লান্তিতে, দুটো রুটি পেটে পড়তেই পুরানো হ্যাভেলির সাঁতস্যাতে ঘরে ঘুমে ঢলে পড়লেন দুজনেই। মহিলা আর নালিশ জানাতে আসেননি। বাঁচা গেছে বাবা। দুটো পাশাপাশি খাটে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন প্রিয়-সুব্রত। রাত ক্রমে গভীর হল। পুরানো হাভেলির ঘর জুড়ে নিস্তব্ধতা। ঘুমের ঘোরও বেশ জোরালো হয়েছে। হঠাৎই শব্দ। মোটা সেগুন কাঠের দরজায় শেকল নাড়ার শব্দে, ভেঙে পড়ছে রাতের স্তব্ধতা। শেকল নাড়ার গতি বেড়েই চলেছে। আওয়াজে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন প্রিয় দাসমুন্সী। সুব্রত’রও ঘুম ভেঙে গেল। আঙুলটা ঠোটের কাছে নিয়ে সুব্রতকে ইশারা করলেন প্রিয়, “ঘুমিয়ে পড় আওয়াজ করিস না বোধ হয় ওই মহিলা। কোন আওয়াজ করবি না। ঘুমের চোখে প্রিয়দার সাজেশন মেনে পাশ মুড়ে ফের শোয়ার প্রস্তুতি নিতে যাবেন, সুব্রত’র এমন সময় কানে এল এক নারী কণ্ঠ “ম্যায় আয়েগা” যেন পাশ থেকেই কেউ বলছে।

আঁতকে উঠে প্রিয়-সুব্রত দুজনেই দেখলেন, এক ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যেই। প্রায় সম্বিত হারাতে হারাতে খাটের পাশের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলেন প্রিয়রঞ্জন। ঘরে আলো ছড়িয়ে পড়তেই দেখা গেল কেউ কোথাও নেই। দু’জনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন দু’জনের দিকে। দু’জনেই যা দেখলেন, তাকি এত বড় মিথ্যা হতে পারে। হাত-পা অসাড় দু’জনেরই। কোনও মতে খাটের নিচে রাখা কুঁজোটা খুঁজে পেলেন প্রিয় দাসমুন্সী, ঢক ঢক করে অনেকটা জল খেলেন।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হতভম্ব ভাব এখনও কাটেনি। সে যাত্রায় আর ঘুম এল না। ভোরের আলো জালনা দিয়ে ঢুকতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রিয়-সুব্রত। বাগানে তখন নরম একটা সকাল সবে ফুটে উঠছে। রাতের হতভম্ব ভাবটা এখনও কাটেনি পুরোটা। বাগানের চেয়ারেই বসে রইলেন সুব্রত আর প্রিয়। সময় অনেকটা গড়িয়েছে। এবার হাভেলির সদর ফটক খুলে একজন বয়স্ক ব্যাক্তিকে ঢুকতে দেখা গেল। সম্ভবত এখানে কাজ করেন। প্রিয় সুব্রতকে দেখেই এগিয়ে এল লোকটি। বুঝেছেন এঁরা এখানে গেস্ট।

“আরে বাবুজি, ইনে সুবহ, গার্ডেন মে ক্যা কর রহে হ্যায়”। লোকটির কৌতূহলি প্রশ্ন? উত্তরে রাতের অবাক কর। অধ্যায় লোকটিকে জানালেন সুব্রত। শুনে চক্ষু কার্যত কপালে তুলে লোকটি বলল, “কৌন আপকো ওহ ঘর দিয়া, “কৌন বেকুব”। “কিউ, ক্যা-হুয়া”, বিস্ফারিত চোখে লোকটির কথা শুনে পাল্টা প্রশ্ন প্রিয়-সুব্রতর।

“আরে বাবু, বহোতদিন পহলে, ইহাঁ পর এক প্রফেসর উনকি বিবিকো লে কর আ উঠি থি উসি ঘর পে। দো দিন কে বাদ, প্রফেসর লা পাতা, অউর উল্কা বিবিকা লাস মিলা ঘরকে অন্দর। তব সে লে কর বহোত লোগো নে রাত মে এক ওউরত কো উসি ঘর কে বাহার দেখা হ্যায়। ফিরভি, কৌই বাত নেহি হ্যায়। ম্যায় দুসরা ঘরকা বন্দবস্ত করতা হু। পহলে চায় তো পি লিজিয়ে। “ভদ্রলোক রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই, সুব্রত মুখার্জি-কে খসখসে গলায় প্রিয় দাসমুন্সি জানতে চাইলেন “কটা বাজে রে?”

-সাতটা।

চল চা খেতে হবে না, বেরিয়ে পড়ি। যা ট্রেন পাব উঠে পড়ব। প্রিয়দা’র নির্দেশ পেয়েই কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা উঠিয়ে, কাউকে কিছু না বলেই, প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে হাভেলি ছাড়ল সুব্রত। সুব্রত মুখার্জির জীবনে ভূত দর্শন অবশ্য এই প্রথম ছিল না। গ্রামের মাস্টারমশাই-এর বড় ছেলে, সংসারের কাজে প্রয়োজনে সাইকেল চালিয়ে বজবজ থেকে আমতলা গেছেন চাল কিনতে। টিউশনি, টেলিফোন অপারেটরের কাজ, সবেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে বিচিত্র কর্মজীবনে। তুখোড় বাস্তব বুদ্ধি, স্পষ্ট কথায় ক্ষুরধার যুক্তি। অথচ তুমুল ভূতগ্রস্ত। ঘাড়ে ভূত এমনই সওয়ার, যে আজীবন লাইট জ্বালিয়ে রাত কাটান। আগে মাথার সামনে থাকত মা কালীর ছবি। ইদানিং হালফিলের প্রযুক্তির হাত ধরে মোবাইল স্ক্রিনএ সারারাত ভেসে থাকেন মা ভবতারিণী। অন্ধকার ঘরে শ্বাশানচারিণীর অভয় ছাড়া শেষে রাতে ভূতের খপ্পরে পড়বেন নাকি? ভূত নিয়ে এতটাই সিরিয়াস মন্ত্রীমশাই। লোকের কাছে যা অমূলক, যুক্তিহীন সুব্রতর যুক্তি সেখানেই।

“ভূতের বিষয়ে আমি যুক্তিবাদী”। প্রায় সময়ই ঘনিষ্ঠ মহলে এমনটাই বলে থাকেন মন্ত্রীমশাই। তার নিজের কথায় “আত্মা অবিনশ্বর, সব আত্মা মৃত্যুর পরই মুক্তি পায় না, শবদেহ যখন পোড়াতে নিয়ে যায়, সাথে সাথে যায়, পাঁচিলের ওপর বসে থাকে। দেহ যখন পোড়ানো হয়, তাই দেখে কাঁদেও। এতো বিশ্বের বড়ো বড়ো মনীষীরাই বলে গেছেন, আমার একার মত নয়”।

শুধু মুখের কথাও না, রীতিমতো সারা জীবনে অসংখ্যবার ভূত দেখেছেন বলেও জোরাল যুক্তি তাঁর। এমনকী অন্যকারও মনে সে যুক্তি সঞ্চারিত হতে বাধ্য। কেউ যদি একবার ভূত বিষয়ক আলোচনায় সুব্রত মুখার্জির পাল্লায় পড়েন তবে তো তাকে দেখতে হয় আর কী! একবার এরকমই এক দার্জিলিং সফরে জনা কয়েক মন্ত্রী দার্জিলিং-এর রাজভবনে গিয়ে উঠলেন। সরকারি সফরে কলকাতার বাইরে সিনিয়র দাদা আড্ডাবাজ সুব্রত মুখার্জিকে পেয়ে ঘিরে ধরেছেন, চন্দ্রিমা ভট্টচার্য, ফিরহাদ হাকিম, অসীমা পাত্রেরা। আড্ডায় অকপট সুব্রত মুখার্জির মুখের কোনও ট্যাক্স নেই। একবার চালু হলে হল, তারপর নদী আপনবেগে পাগলপারা। একথা, সে কথার পর অবধারিত ভাবে সেদিনও উঠে এল ভূতের প্রসঙ্গ। সুব্রত মুখার্জি প্রমাণ করেই ছাড়বেন ভূত আছে শুধু না, “এই, এই যে বসে কথা বলছি, এ ঘরের আনাচে কানাচেও হয়তো ভূত আছে। না হলে এই বারান্দায় তো আছেই”।

যাই হোক রাত গভীর হলে রাজভবনের হলঘর ছেড়ে যে যার ঘরের দিকে রওনা হলেন, কানে বাজতে লাগলো ভূতের অস্তিত্বের দাবিতে সুব্রতর সম্মোহনী যুক্তি। তা যে কতটা সংক্রামক তা বিলক্ষণ টের পেলেন ফিরহাদ হাকিম।

“ঘরে ঢুকেই গা-টা কেমন ভারী হয়ে উঠল। অন্যান্য দিন লাইট নিভিয়ে শুই, সেদিন আর লাইট নেভানোর সাহস হল না। খালি বারান্দার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল, চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে ঘুম আসছে না, এদিকে প্রবল চাপ অনুভব করছি, তবু বিছানা ছেড়ে বাথরুমে যাওয়ায় জো নেই”। বাকিদের অবস্থা কি হয়েছিল। তা অবশ্য কারো জানা নেই। তো সুব্রত মুখার্জির ভূতের গল্প এমনই। আসলে যে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন ভূতের অস্বিত্বে। ছোটোবেলায় বজবজে থাকতে, গ্রামেরই এক পরিত্যক্ত দোতালা বাড়ির ছাদে বন্ধুদের সঙ্গে হ্যারিকেনের আলোয় রাত জেগেই পড়তে গিয়েছিলেন সুব্রত। পরীক্ষার আগে যদি রাত জেগেই পড়া না হল, তবে সে ছাত্র কীসের। অতএব পোড়ো বাড়িতে লণ্ঠনের আলোয় শুরু হল পড়া। ক্রমে রাত অনেক গভীর হল, পড়াশোনা গুন গুন ধ্বনিতে গমগম করছে জনা ছয়েক কিশোরের ছোট জটলা। হঠাৎ বাড়ির দরজায় সজোরে শব্দ, ঠক ঠক। শব্দটা কানে আসতেই কেউ-ই খুব একটা পাত্তা না দিয়ে চালিয়ে গেল পড়াশোনা।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার, ঠক ঠক, ঠক ঠক। দরজায় কে যেন সজোরে কড়া নাড়ছে। এবার একটু যেন ভয় ভয় করতে লাগল সুব্রতর। সেদিনের মতো পড়া থামল। কিন্তু পরদিন আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এভাবে তিন-চারদিন চলার পর, সুব্রত আর তার বন্ধুরা অনুভব করল কিছু তো একটা করতেই হয়, এদিকে বাড়িতে বিষয়টি জানাজানি হলে, রাতের পড়াটাই বন্ধ হয়ে যাবে। কি যে করা যায়। বন্ধুদের, একজনই বলে উঠল, চল দরজার গায়ে গায়ে রাম নাম লিখে দিই চক দিয়ে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সুব্রতদা’র করায় “রামনাম খড়ি দিয়ে লিখে দিতেই উৎপাত থামল, আর আমার মনে ভূতেরা পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিলেন”।

এহেন অলৌকিক ভূতগ্রস্ত সুব্রত মুখার্জি কোনও দিনও প্লানচেট করেননি, ভূতেদের সাক্ষাৎ পেতে। তবে ভূতেরা বহুবারই তাকে সাক্ষাৎ দিয়ে গেছেন। সুব্রত মুখার্জি’র ভূত দেখার বিখ্যাত গল্প ১৯৭২ সালের রাইটার্স বিল্ডিং-এ।

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাশাপাশি তখন তথ্যও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন সুব্রত মুখার্জি। তখন দেশজুড়ে চলছে জরুরি অবস্থা। খবরের কাগজে পরিবেশিত সংবাদ, রীতিমতো সরকারি অনুমোদন নিয়ে ছাপতে হতো। সরকারের না পসন্দ খবর হেডলাইন পর্যন্ত বাতিল হত মন্ত্রীর কলমের খোঁচায়। দুর্ভাগ্যজনক এই কাজের ভার এসে বর্তাল সুব্রত মুখার্জির ওপর। সারাদিনের সরকারি কাজের পর বিকেলে বাড়ি ফিরে, পার্টির কাজকর্ম সেরে আবার রাত্রিবেলা যেতে হত রাইটার্স বিল্ডিং-এ খবরের কাগজের খবরগুলি খতিয়ে দেখে, বাতিল অথবা ছাপার অনুমোদন দিতে। একদিকে জরুরি অবস্থা, অন্যদিকে রাত দশটা’র অফিসপাড়া। গোলদিঘির পাড়ে ঘনকালো গাছের সারিতে মাথা তুলে রয়েছে রাইটার্স বিল্ডিং। জনশূন্য রাস্তায় জনাকয় পুলিশের পায়ের শব্দ। প্রতিদিন এরকমই থাকে পরিবেশ। সুব্রত মুখার্জি সেদিনও এসে পৌঁছলেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ। সাদা অ্যাম্বাসাডর রাইটার্স-এর গাড়ি বারান্দায় ভিআইপি লিফট-এর সামনে এসে থামল। লিফট-এর সামনেই মন্ত্রীমশাইকে দেখে স্যালুট জানাতে হাজির এক কনস্টেবল। বেশ কয়েকজন কনস্টেবল থাকেন এই গেটে। আজ একজনই রয়েছেন ডিউটি’তে। সুব্রতকে দেখে যান্ত্রিকভাবেই উঠে দাঁড়াল লোকটা, লিফটের কোলাপসিবল দরজাটা খুলে দিলেন। লিফট-এ উঠলেন সুব্রত। অন্যান্য দিন সুব্রতকে দেখালে পাহারারত এই সব কনস্টেবলরা আগ্রহ সহকারে কথা বলবার জন্য মুখিয়ে থাকেন। অথচ আজ কিছুই নেই। লিফট-এ মন্ত্রীকে তুলে দিয়ে কেমন নিরাসক্ত ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল কনস্টেবলটি। দাড়িওয়ালা এই লোকটিকে সুব্রত এই গেটে ডিউটি করতেও দেখেছেন বহুবার। কাজেই লিফটাটি ওপরের দিকে উঠতেই আঁড়চোখে লোকটির দিকে তাকবার চেষ্টা করলেন সুব্রত। মাথা নীচু, গালে লম্বা দাঁড়ির গোছা। লিফট একতলা ছাড়াতে ছাড়াতে সুব্রত’র কেন জানি না মনে হল লোকটার পা যেন ঠিক মাটিতে নেই। মাটি থেকে একটু উঁচতে হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাবনাটা মাথায় আসতেই, মাথাটা কেমন কাজ করছে না সুব্রত’র। কিন্তু বেশিক্ষণ সে ভাবনা স্থায়ী হল না। দোতালায় লিফট থেকে নামতেই ছেঁকে ধরলেন খবরের কাগজের সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদকরা। প্রতিদিনকার মতো খবরের কাট ছাট পর্ব শুরু হল। চলল প্রায় দু’ঘণ্টা। মাথা থেকে অন্য সবকিছু বেরিয়ে গিয়েছে।

কাজ শেষে আবার লিফট করে নেমে এলেন একতলায়। মাননীয় মন্ত্রীকে দেখে মুখ কাচু মাচু করে ছুটে এলেন এক কনস্টেবল। এবারের কনস্টেবলটি নতুন। যাওয়ার সময় যাকে দেখেছেন সে নয়। তাই মন্ত্রীমশাই কনস্টেবলটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সঙ্গে আরেকজন কোথায়? বলেই একটু পা বাড়িয়েছেন, পেছন থেকে কনস্টেবলটি বলে উঠল “আর কেউ তো নেই স্যার, এই গেটে তো আমি একা। আপনি ঢোকার সময় আমি ছিলাম না স্যার, টয়লেট গেছিলাম ক্ষমা করবেন।” লোকটির কথা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন সুব্রত।
“না না, ওই যে দাড়িওয়ালা কনস্টেবলটি গেল কোথায়? এখানেই তো ছিলেন। মন্ত্রীর কথা শুনে কনস্টেবলটি বলে উঠলেন “কে আনোয়ার? ও এখানে থাকবে কি করে, ও তো। ওঠার সময় দাঁড়িয়েছিল।

কথা শেষ না হতেই মন্ত্রীমশাই বলে উঠলেন, এই তো আমি লিফটে

“না, মানে স্যার, সে কি করে হবে? মানে আনোয়ারদা তো গত সপ্তাহে মারা গেছে।” স্যার বড়ো বড়ো চোখ করে জানাল কনস্টেবলটি।”

কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ মেরে গেলেন সুব্রত। গলা থেকে কোনও স্বর বের হচ্ছিল না। কনস্টেবলটি বলেই চলেছে “তাই বলছিলাম আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে”। কোনও কথাই অবশ্য কানে উঠছে না সুব্রত’র। সে জানে ভুল তার হয়নি, সে আনোয়ারকে দেখেনি। দেখেছে তার অশরীরী সত্ত্বাকে। সারা শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল তেড়িয়া ছাত্র নেতার। ঘনিষ্ঠ মহলে সেদিনের প্রসঙ্গে সুব্রত মুখার্জি প্রায়ই বলতেন, “আসলে গ্রাম থেকে আসা মানুষ, রাইটার্সে মন্ত্রীদের লিফটের সামনে ডিউটি করাটা ওঁর কাছে ছিল শ্লাঘার ব্যাপার, তাই মৃত্যুর পরও সেখানকার মায়া কাটাতে পারেনি।”

সুব্রত মুখার্জির মতে রাজনীতি বড় মায়ার ব্যাপার। আর সেই কারণেই কেউ মৃত্যুর পরও মায়া কাটাতে পারে না। ফিরে ফিরে আসে। আড্ডার মেজাজে প্রায়ই বলে ওঠেন।” সবচেয়ে বেশি মায়া কর্পোরেশনে, যখন মেয়র ছিলাম, অ্যান্টি চেম্বারে ঢুকলেই মনে হতো, পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পর্দার আড়ালে কি যেন ছায়া সরে গেল, দেখতাম। তবে সব ভূতই ক্ষতিকারক নয়, এমনকি ক্ষতি করার ক্ষমতাও তাদের থাকে না।” এই বিশ্বাসই সুব্রত’র মনে বদ্ধমূল। স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের কোলে বসে দীক্ষা নিয়েছিলেন তাঁর বাবা। সুব্রত’র চওড়া পিঠে বাপের হাতের বেতের বাড়ির অনুভূতি বহুদিন স্পষ্ট ছিল। আর মনে লেগে ছিল, শিক্ষক বাবার সোনা দিয়ে মোড়ানো উপদেশগুলি। গড়িয়াহাটের বাড়িতে রুটি আর পটলভাজা দিয়ে নৈশভোজ সারছেন সুব্রত মুখার্জি। মন্ত্রীমশাই-এর মাথায় চিন্তার চলাচল লেগেই থাকে, অসতর্কতায় হঠাৎ-ই পটলের দানা ঢুকে যায় শ্বাসনালিতে। মুহূর্তের জন্য যেন সব অন্ধকার। শ্বাস ফেলতে পারছেন না। স্ত্রী ছন্দবানী মুখার্জিকে বললেন ডাক্তারের কাছে ফোন করতে। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, একপ্রস্থ বমি হয়ে গেল। তবু নিস্তার নেই। ঘরের পোশাক পরেই ডাক্তারের কাছে যাবেন বলে বেরনোর উদ্যোগ নিলেন। সদর দরজার পাশের চেয়ারে রাখা বাবার ছবিটা হঠাৎ পড়ে গেল। বাবার ছবিটা, তুলে রাখতে ঝুঁকলেন সুব্রত আর তখনই ম্যাজিকের মতো পটলের দানাটা মুখ থেকে মাটিতে পড়ল। এবার অনেকটা রিলিফ। বুকভরে শ্বাস নিলেন সুব্রত। জানালা বেয়ে এক হিমশীতল বাতাস মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল। ছবির দিকে চেয়ে প্রণাম করলেন সুব্রত, অস্ফুটে বললেন “বাবা”। শ্বাসনালিতে আটকে যাওয়া পটলের কালো দানাটা ধুয়ে আলমারিতে রেখে দিয়েছেন। সেদিন রাত্রে লাইট জ্বালিয়েই শান্তিতে ঘুম হল। বাবার কথা মনে পড়ছিল, ঘরটা হিমেল বাতাসে ভরে যাচ্ছিল, সে বাতাসে নিছক ভয় ছিল না। বয়েস হলে মাথার ওপর থেকে আশীর্বাদের হাত এক এক করে সরে যায়। বাবার মতোই ইন্দিরা গান্ধীও চলে যান। সুব্রতর জীবনের বড় ভরসা ও প্রেরণা।

সুব্রত জানতেন প্ল্যানচেট করেও আর লাভ নেই। কারণ ইন্দিরার আত্মা মুক্তি পেয়েছে বলেই বিশ্বাস সুব্রতর। প্রিয়দার আত্মাও মুক্তি পেয়েছে। সুব্রতর এমনই দৃঢ় মত। আশীর্বাদ ছড়িয়ে রেখে তারা চলে গেছেন। সেই আশীর্বাণীর পাশেই বাতাসে একটু ভয় ভয় ভাব। কখন কোনও অতৃপ্তের সঙ্গে দেখা হয়। মোবাইল-এ জ্বালানো ভবতারিণীর ছবিতে কপাল ঠুকে পাশ ফিরলেন সুব্রত। এখন অনেক রাত। বাতাসে জ্বিন, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য। আর দূর থেকে সুব্রতকে দেখছেন মা-বাবা আর পূর্বপুরুষরা তাঁর ভালবাসার জন।

লেখা সূত্র: চেনা নেতা অচেনা নেতা

লেখক: সাংবাদিক সৌরভ গুহ