দেশ

পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি, কাল্পনিক কবিতা আর বাস্তব ছবির যুদ্ধ এক অন্য মহাকাশে

Chandrayaan-3 Cost

পূর্ণেন্দু ব্যানার্জি: ৬৫০ কোটি। হ্যাঁ মাত্র ৬৫০ কোটি। এই যৎসামান্য টাকাতেই ভারতের চন্দ্রযান ৩ ভারতের এক নয়া উড়ানকে সাফল্য দিয়েছে। চাঁদের দক্ষিণমেরুতে বিশ্বের প্রথম কোনও দেশ পা রেখেছে। দেশবাসী হিসেবে প্রত্যেকের কাছে ২৩ অগাস্ট ২০২৩ একটি স্মরণীয় দিন হিসেবে থেকে যাবে। এমনকি বিশ্ব ইতিহাসের পাতাতেও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ভারতের এই সাফল্য অভিযানের কথা।

আসলে বিশ্বের নজরে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারত মহাকাশে যে স্বাক্ষর রেখেছে, তা নিয়ে সারা বিশ্বের একটা অংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও, অনেকে মেনে নিতে পারছেন না এই সাফল্য। স্বাভাবিক, অন্য কারও সাফল্য যে সবার ভালো লাগবে তার তো কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, কেউ ঈর্ষান্বিত হোক বা না হোক, নিজেদের কর্মে, লক্ষ্যে স্থির থেকে, সাধনা চালিয়ে গেলে যে সাফল্য মেলে, কোনও প্রতিবন্ধকতা যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না, তা আরও একবার প্রমাণ করল ইসরো। আরও পড়ুন-বিশ্বরেকর্ড গড়ল টিউলিপ গার্ডেন 

কাহিনি এখানেই শেষ নয়, কাহিনির মূল কাঁটা চন্দ্রযানের টাকার অঙ্কে, সারা বিশ্বই অবাক এতো কম টাকায় সাফল্য এলো কীভাবে? কোন ফর্মুলায় অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটালেন ভারতের বিজ্ঞানীরা! কারণ তাঁরা যে কাজটি করে দিয়েছেন, তা আন্তর্জাতিক স্তরে মহাকাশের ময়দানে নয়া শক্তিতে পরিণত করেছেন ভারতকে।  সত্যি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু… কিন্তু… কিন্তু।

একটা কিন্তু এসে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতোই ক্রমেই টেনে নিয়ে যায়, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কল্পকবিতায় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। জানেন কি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য বাৎসরিক কত কোটি টাকা খরচ হয় ? মাত্র ৬০০ কোটির কাছাকাছি। জানেন কি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, ব্যানার হোর্ডিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রচারমূলক বিজ্ঞপ্তির জন্য যে পরিমাণ খরচ হয়, সেই খরচে দুটি চন্দ্রযান চাঁদে পৌঁছে যেতে পারে। না প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সামাজিক প্রকল্পের প্রচারে বিপুল খরচ হতেই পারে হওয়া উচিৎও। কারণ দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আপোষ কোনও অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যা না। কিন্তু অঙ্ক অন্য জায়গায় গরমিল হতে শুরু করে। যখন কম্পট্রোলার অফ অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসে। হরিয়ানার দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির খরচ দেখলে চোখ কপালে ওঠে। প্রতি কিলোমিটারের খরচ ধরা হয়েছিল, ১৮.২০ কোটি টাকা। সেখানে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৫০ কোটি টাকার বেশি। এই মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। অর্থাৎ ১৯ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে মাত্র তিন কিলোমিটার রাস্তা তৈরির যা খরচ, তাতে একটা চন্দ্রযান অনায়াসে তৈরি হয়ে যেতে পারে। দেশের পাটিগণিত এক অন্য ধারার ইঙ্গিত দেয়, যখন দেশের ও প্রধানমন্ত্রীর সুরক্ষা ব্যবস্থা থেকে পরিকাঠামো উন্নয়নে এক লাফে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ে, সেখানে ইসরোর মতো সংস্থার বাৎসরিক বরদ্দা কমিয়ে ফেলা হয়।  ২০২২-২৩ সালে যেখানে ১৩৭০০ কোটি টাকার বাজেট ছিল, ২০২৩-২৪ সালে ১২,৫৪৩.৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মজার ব্যাপার গত আর্থিক বছরের ডলার বনাম ভারতীয় মুদ্রার যা মূল্য ছিল, চলতি আর্থিক বছরে তার থেকে বেড়েছে। ফলে, সেখানেই টাকার অঙ্ক অনেকটাই কমে যাচ্ছে।

দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, যে হারে বিদেশী বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখেছিল দেশবাসী, সেভাবে গত ৯ বছরে তেমন কোনও সংস্থা আসেনি। সারা বিশ্বে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার শীর্ষ তালিকায় রয়েছে ভারত। তবু বছরের পর বছর বাড়ছে জীবনদায়ী ওষুধের দাম। দেশের কর ব্যবস্থা শক্তিশালী হলেও, নতুন প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ সমবণ্টন হচ্ছে না। ফলত, সমস্যা সেই তিমিরেই থাকছে। ধীরে ধীরে বদলে ফেলা হচ্ছে গণবণ্টন ব্যবস্থার বুনায়াদি কাঠামোকেই। ফলত, দেশের মেট্রো শহরগুলির হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের মাথা থেকে চাঁদকে হয়তো কিছুটা কাছে পাওয়া যায়। বিশ্বের মঞ্চে নয়া শক্তির প্রদর্শন হয়তো করা যায়। প্রজ্ঞান চাঁদের দক্ষিণমেরুতে বিচরণ করে, অনেক অজানা তথ্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে। কিন্তু প্রশ্ন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছয়নি, পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবে প্রতিবছর বহু মানুষকে অকালে গ্রাস করছে মৃত্যু। অপুষ্টিতে ভুগছে শিশু ও মা। সেই অন্ধকার ঝলসানো রুটির দক্ষিণ মেরুতে, কোন প্রজ্ঞান গবেষণা চালাবে? হয়তো একসময় এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেবে, আমজনতার বিবেকের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা কোনও এক ধার্মিক প্রজ্ঞান। সমাজের অন্ধকার দিকে আলো ফেলে, তুলে আনবে এমন এক সত্যকে। যে বদলে দেবে নয়া দিশা।

 

 

Related Articles