সম্পাদকীয়

সংবিধানের দেওয়া অধিকার কী পাচ্ছে দেসবাসী?

তিনি যে সংবিধানের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধ, সংবিধান রক্ষায় তাঁর যে কত আন্তরিক প্রচেষ্টা, প্রতিটি ভাষণে সেটিই তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন এ পর্যন্ত।

রন্তিদেব সেনগুপ্ত (বিশিষ্ট সাংবাদিক): ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের গণপরিষদে স্বাধীন দেশের সংবিধানটি গৃহীত হয়। পরের বছর, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর ২০১৫ সালে এই ২৬ নভেম্বর দিনটিকে কেন্দ্র সরকার সংবিধান দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে প্রতিটি বছর সরকারি স্তরে এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘটা করে এই দিনটিতে ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি যে সংবিধানের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধ, সংবিধান রক্ষায় তাঁর যে কত আন্তরিক প্রচেষ্টা, প্রতিটি ভাষণে সেটিই তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন এ পর্যন্ত। এ বছরও সংবিধান দিবসে তিনি তাই করেছেন।

মোদি বরাবরই নাটকীয়তায় অনন্য। সেনাবাহিনী সফল হলে তিনি সেনার পোশাকে মঞ্চে অবতীর্ণ হন। তিনি ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিষ্কার করতে নামেন। সংসদে প্রবেশ করার মুহূর্তে তিনি আভূমি প্রণত হয়ে সংসদ ভবনকে শ্রদ্ধা জানান। এমনকি নিজের অসুস্থ মা-কে দেখতে গেলেও তাঁর পিছনে ক্যামেরাম্যান সক্রিয় থাকে। মোদি জানেন নাটকীয়তায় কিভাবে প্রচারের আলো কেড়ে নেওয়া যায়, কিভাবে জনমানসে নিজের একটি লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ গড়ে তোলা যায়।

প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসার পর নরেন্দ্র মোদি সংবিধান দিবস ঘোষণা করেছিলেন, এরকম শোনার পর কেউ যদি ভেবে থাকেন দেশের সংবিধানের প্রতি মোদির অটুট শ্রদ্ধা, সংবিধান নির্দেশিত পথের বাইরে মোদি পা বাড়ান না, তা হলে বলতেই হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে তিনি চেনেননি। সংবিধান দিবস পালন এবং সেই দিবসে সংবিধানের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেকে জাহির করাটাও মোদির নাটকীয়তারই একটি অঙ্গ। নিজেকে লার্জার দ্যান লাইফ প্রতিপন্ন করারই চেষ্টা।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর স্বয়ংসেবক হিসাবে মোদির উত্থান। এই আরএসএস কখনই স্বাধীন ভারতের সংবিধানকে মান্যতা দেয়নি। আরএসএস বরাবরই মনে করেছে এই সংবিধানকে বর্জন করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র পরিণত করাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া দরকার। সংঘের দ্বিতীয় সরসংঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের লেখাগুলি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা সংগঠন বিজেপি এই ধারণাটি নিয়েই চলে। সেই সংঘ-বিজেপিতে লালিত নরেন্দ্র মোদি অন্যরকম ভাববেন কেন?

না, তিনিও অন্যরকম ভাবেন না। তাঁর গত এগারো বছরের কর্মকাণ্ড দেখলেই বুঝতে পারবেন, সংবিধান দিবসে তিনি যা যা বলেন আসলে সেগুলি ভান-ভনিতা। কার্যক্ষেত্রে তিনি করেন উল্টোটা।

দীর্ঘ এক স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসটিকে মনে রেখেই এদেশের সংবিধানের রূপকাররা সংবিধান রচনা করে গিয়েছিলেন। সেই সংবিধানে প্রতিটি ধর্মের, প্রতিটি বর্ণের, প্রতিটি শ্রেণির মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিকে রক্ষা করার কথা বলা রয়েছে। একটি অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত হয়েছিল এই সংবিধান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে আমরা কী দেখলাম? দেখলাম নির্বাচনি প্রচারে বেরিয়ে তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণার বিষ উগরে দিচ্ছেন। বলছেন, বিজেপি না জিতলে নাকি হিন্দু মহিলাদের গলার মঙ্গলসূত্র খোয়া যাবে। বললেন, পোশাক দেখে নাকি চেনা যায় কে কোন ধর্মের মানুষ। যে দেশের সংবিধান দেশের প্রতিটি ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দিয়েছে, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই বক্তব্য কি সংবিধান অবমানানরই নামান্তর নয়?

গত এগারো বছরে প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে সংবিধানকে অমান্য করেছেন মোদি, প্রতিটি পদক্ষেপে অবমাননা করেছেন সংবিধানের। আমাদের সংবিধানে দেশের মানুষকে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার দেওয়া আছে। গত এগারো বছরে মোদি জমানায় ঘটেছে উল্টোটা। সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে। অনেক প্রগতিশীল মুক্তচিন্তক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জড়িয়ে কারান্তরালে পাঠানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত এগারো বছরে সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন স্বতন্ত্র সংস্থাগুলির স্বাধীনতা একের পর এক হরণ করা হয়েছে। সর্বশেষ উদাহরণ নির্বাচন কমিশন, যেখানে আইন বদলে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে শাসক দলের পছন্দসই ব্যক্তিকে নিয়োগ করে নির্বাচনটি শাসকের স্বার্থে পরিচালনা করার পাকাপাকি ব্যবস্থা করে ফেলেছেন মোদি। সংবিধানের রূপকাররা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আজ এই মোদির আমলেই ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের নাম করে দেশের বৃহৎ অংশের নাগরিককে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদিকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা ভাবার কোনও কারণই নেই। সংবিধান দিবসে তিনি যতই আবেগঘন বক্তৃতা দিন না কেন, আসলে আরএসএস-এর স্বয়ংসেবক হিসেব ভারতের সংবিধানকে ডাস্টবিনেই নিক্ষেপ করতে চাইছেন তিনি।

Related Articles