সম্পাদকীয়

৩৪ বছর বয়সে ৩৪টা ভাষার ওপর আধিপত্য! বিস্ময়কর ভাষাপথিক হরিনাথ দে

হরিনাথ এতগুলো ভাষা আয়ত্ত করলেও তাঁর ভাষাজ্ঞান মোটেই ভাসা ভাসা ছিল না। প্রতিটি ভাষাই তিনি শিখেছিলেন কঠোর পরিশ্রম করে, গভীর অনুরাগের সঙ্গে।

রাজু পারাল: ‘হরিনাথ দে’ নামটা উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে যায় ভাষাবিদ সেই জাদুকরের কথা। যিনি তাঁর জীবনটাকেই উৎস্বর্গ করেছিলেন ভাষা শিক্ষার জন্য। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে শিখে নিয়েছিলেন ৩৪টা ভাষা। ভাষার বুৎপত্তি থেকে আরম্ভ করে প্রয়োগ পর্যন্ত ভাষার যাবতীয় চর্চা হরিনাথ আত্মস্থ করেছিলেন। সমকালে হরিনাথের প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি। যে মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য ছিল তা তিনি পাননি। তবে পরিণত বয়সে তাঁর পাণ্ডিত্য, প্রাচ্য তত্ত্বে তাঁর গভীর জ্ঞান, ভাষা সম্পদের বিপুল ক্ষমতা, প্রাচীন থেকে আধুনিক জ্ঞান চর্চায় তাঁর অনায়াস গতিবিধি, অধীত বিষয়ে তাঁর গভীর অনুশীলন ইত্যাদি গুণাবলির জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিতগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে হরিনাথকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন।

প্রশ্ন জাগে একি বাস্তব নাকি অলীক কল্পনা? উত্তর হবে সম্পূর্ণটাই বাস্তব। ল্যাটিন, গ্রিক, আরবি, সংস্কৃত, পালি, চিনা, জাপানি, পারসিক, জার্মানি, ইংরেজি, ফারসি, ইতালীয় ইত্যাদি অজস্র ভাষায় তিনি দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন অল্প বয়সেই। হরিনাথ এতগুলো ভাষা আয়ত্ত করলেও তাঁর ভাষাজ্ঞান মোটেই ভাসা ভাসা ছিল না। প্রতিটি ভাষাই তিনি শিখেছিলেন কঠোর পরিশ্রম করে, গভীর অনুরাগের সঙ্গে। শোনা যায়, গ্রিক, ল্যাটিন, ফরাসি, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন। ল্যাটিন ভাষায় তিনি ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ কবিতার এক অপূর্ব অনুবাদ করেছিলেন। হরিনাথের স্মৃতি শক্তি ছিল বিস্ময়কর।

একবার যা পড়তেন হুবহু তাঁর মস্তিষ্কে খোদাই হয়ে যেত। এ সব গুণই তিনি পেয়েছিলেন মা এলোকেশী দেবীর কাছ থেকে। এলোকেশী দেবী ঘরোয়া মহিলা হলেও হিন্দি, ইংরেজি এবং মারাঠি ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি বালক হরিনাথকে পাশে বসিয়ে অক্ষর জ্ঞান শিখিয়েছিলেন যথেষ্ট যত্ন সহকারে। হরিনাথও সে সব শিখেছিলেন আগ্রহ সহকারে। একসময় পুত্রের প্রবল পাঠতৃষ্ণার কাছে তিনি নতি স্বীকার করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সেখানকার অধ্যাপক পার্সিভ্যাল সাহেব একবার তাঁর ক্লাসের ছাত্রদের হরিনাথ সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘উনি বেশ কয়েক বছর আমাকে ল্যাটিন এবং গ্রিক শিখিয়েছিলেন।’

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব’ বিভাগে অধ্যাপক পদে হরিনাথ নিযুক্ত হলেও পরে তিনি তা ত্যাগ করেন। যোগদান করেন ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে’ (বর্তমানে, জাতীয় গ্রন্থাগার)। তাঁর এই পদপ্রাপ্তির খবর পেয়ে লর্ড কার্জন ইংল্যান্ড থেকে তাঁকে এক অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করে লেখেন, ‘সঠিক মানুষটি সঠিক স্থানে চাকরি পেয়েছেন।’ নানা কারণে ভারতবাসীদের কাছে অপ্রীতিভাজন হলেও লর্ড কার্জন যেহেতু একজন বিদ্যানুরাগী তাই এক্ষেত্রে পাণ্ডিত্যপূর্ণ মানুষটিকে প্রশংসা না করে পারেননি।

ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে কাজ করার সময় হরিনাথ প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহের দিকে যেমন ঝুঁকেছিলেন, তেমনই বহু বিচিত্র বিষয় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহের এমনই নেশা ছিল যে সারাটা জীবন হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামে হাজির হয়ে সন্ধান পেয়েছিলেন কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’র প্রাচীন পুঁথি। ভাবলে অবাক হতে হয় হরিনাথের সংগ্রহে ছিল পার্সি ও তুর্কি ভাষায় লেখা বৈরাম খানের একমাত্র পাণ্ডুলিপি থেকে ওয়ারেন হেসটিংসের নিজের হাতে লেখা চিঠি। দারাশুকোর রচিত বেদের পার্সি অনুবাদও ছিল হরিনাথের সংগ্রহে। শোনা যায়, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হরিনাথের সংগ্রহে ছিল সাত হাজার পুঁথি ও পুস্তক যার আনুমানিক মূল্য ছিল পঁচিশ পুঁথি টাকা।

অনুবাদ কার্যেও হরিনাথ অর্জন করেছিলেন বিশেষ দক্ষতা। অনেকগুলি অনুবাদ তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে করেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অমৃতলাল বসুর ‘বাবু’ ও ‘রাজাবাহাদুর’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ বন্দেমাতরম’, ‘মুচিরাম গুড়’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সিরাজউদৌল্লা’, বিদ্যাপতির ‘পদাবলী’ ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত চিনা পুঁথি অনুবাদ ও সম্পাদনাও করেছিলেন হরিনাথ। হরিনাথের সম্পাদিত গ্রন্থ, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা, গবেষনামূলক প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র্য, অনূদিত রচনার প্রাচুর্য ইত্যাদি আলোচনা করলে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তা ভাবনার বৈচিত্র্য এবং সর্বব্যাপী জ্ঞানচর্চার আগ্রহ আমাদের বিস্মিত করে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন জ্ঞানতাপস। অগাধ পাণ্ডিত্য ও অপরিমেয় ভাষাজ্ঞান ছাড়াও তাঁর চরিত্রের আর একটা গুণ ছিল মহানুভবতা।

অনেক গবেষকও হরিনাথের কাছ থেকে বহু সাহায্য পেয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এই উদার মানসিকতা হরিনাথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নিজের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে কত যে দানধ্যান তিনি করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। বিদ্যাসাগরের পর তাঁর মতো ওইরকম হৃদয়বান মানুষ খুব কমই জন্মেছিলেন। কখনও কেউ অভাবে পড়েছে বা কেউ টাকার অভাবে পড়তে পারছে না শুনতে পেলে নিজের যথাসাধ্য দিয়ে তার পাশে দাঁড়াতেন। এমন দিনও গেছে মাসের প্রথমে মাইনের পুরো টাকাটাই দান করে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। এর জন্য তাঁকে অবশ্য প্রায়শই ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে।

পাওনাদারদের কাছে অনেক রূঢ় কথাও শুনতেও হয়েছে। নিদারুণভাবে গৃহশান্তিও বিঘ্নিত হয়েছে। হরিনাথের জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হল স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণপুরুষ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একদা হরিনাথের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। তাঁর পদোন্নতি ও প্রতিষ্ঠার মুলে আশুতোষের অবদান ছিল প্রচুর। পরবর্তীকালে নানা কারণে ঘটনাচক্রে এই দুই কিংবদন্তি মনীষীর মধ্যে মনান্তর ঘটে। অনেকের অনুমান এই মনান্তরের ফলেই হরিনাথ মানসিক রোগে বিপর্যস্ত হয়ে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে। বিভিন্ন ভাষা ও জ্ঞানরাজ্যের এক বিস্তৃত ভূমিতে হরিনাথ আজও একক।

Related Articles