মুখে মাস্ক, মাথায় হেলমেট, মোটরবাইকে এসে ফাঁকা শহরের রাস্তায় চুপিসাড়ে ছেড়ে দিয়ে যায় মশা, ওরা কারা? উদ্দেশ্য কী!
fighting dengue what is project wolbachia and how are mosquitoes made

The Truth Of Bengal : সবে ভোরের আলো ফুটেছে শহরের বুকে। পুরসভার কর্মীরা রাস্তায় পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। গুটিকয়েক মানুষ বেরিয়েছেন রাস্তায় প্রাতর্ভ্রমণে। এমন সময়ই রাস্তার গলির মুখে এসে দাঁড়াল একটি মোটর বাইক। যুবকের মাথায় হেলমেট, মুখে মাস্ক। পীঠে একটা পেল্লাই ব্যাগ। যুবকটি কয়েকবার আশ পাশ ভালো করে দেখে নিল। তারপর ব্যাগ থেকে বের করল একটি গ্লাসের মতো বস্তু। তার মুখ খুলতেই পিলপিল করে বেরিয়ে এলো মশা। তারা ছড়িয়ে পড়ল, পাড়ার অলিতে গলিতে। যুবকটি গ্লাসটিকে ব্যাগের মধ্যে পুরে দুরন্ত গতিতে বেরিয়ে গেল।
এই চিত্রটিকি কোনও রহস্যময় সিনেমার একটি দৃশ্যের মতো লাগল? কোনও কাল্পনিক গল্পের মতো মনে হল? তাই যদি মনে হয়ে থাকে, তাহলে বলবো, না এই দৃশ্য দেখা যায় আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশে এমনকী সিঙ্গাপুরেও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুবকেরা এসে আচমকা শহরের মধ্যে মশা ছেড়ে দিয়ে যায় কেন?
কাহিনীর শুরু ২০১৬ সালে। ডেঙ্গি, ম্যালেরির দাপট থেকে বাঁচতে সিঙ্গাপুরে শুরু হল এক নতুন গবেষণা। দেখা গেল এক ধরণের ব্যক্টিরিয়া রয়েছে, যা ডেঙ্গি, মেলেরিয়া মশাদের যম। শুরু হল, এক ভিন্ন প্রজাতির মশা তৈরির। যার মধ্যে থাকবে ওই ব্যাক্টেরিয়া। অর্থাৎ যে মশা জন্ম নেবে, তাদের মধ্যে ব্যাক্টেরিয়াটি ডিএনএতেই থেকে যাবে। ফলে সেই মশা, সাধারণ মানুষকে কামড়াবে না এমনকী কোনও রোগও ছাড়বে না। অথচ, এই মশাকেই যখন শহরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে, তারা এডিস মশাকেই আক্রমণ করবে। একপ্রকার যেন মশা নিধনে, মশার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। এই মশার পোশাকি নাম ওয়ালবাচিয়া। অর্থাৎ এক প্রজাতির পুরুষ মশার মধ্যে ওয়ালবাচিয়া ব্যাক্টেরিয়া ইনজেক্ট করেই প্রজনন ঘটানো হচ্ছে।
গবেষকদের দাবি, ওয়ালবাচিয়া মশা যখন এডিস মশার সঙ্গে সঙ্গম করে, তখন, এডিস মশা ওয়ালবাচিয়া ব্যাক্টেরিয়ার কারণে গর্ভধারণ করতে পারে না। আর পুরুষ ওয়ালবাচিয়া মশা, কামড়ায় না, কোনও রোগও ছড়ায় না। ২০১৬ সাল থেকে গবোষণার পর ব্যাপক সাফল্য মিলেছে। ২০১৯ সালেই সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি মশার জন্ম দেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গি ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে প্রতি মাসে পনেরো থেকে কুড়ি লক্ষ মশা ছাড়া হয়ে থাকে। গবেষকদের দাবি, তিন থেকে চার বর্ষার মরসুমে মূলত এডিস মশার প্রকোপ বাড়তে থাকে। সেই সময়ই ওয়ালবাচিয়া মশাদের ছাড়া হয় শহরে। বিভিন্ন আবাসনগুলির আশে পাশে। এই ‘ভালো মশার’ কারণে এক ধাক্কায় ৮৮ শতাংশ ডেঙ্গি আক্রন্তের কেস কমানো গিয়েছে।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির গবেষকদের দাবি, আগে মশা মারতে কামান ব্যবহার করা হত। যদিও সেই ধোঁয়াতে মশার থেকে মানুষেরই বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। এমনকী একধরণের কীটনাশকও ব্যবহার করা হয়েছে থাকে। সেই সমস্ত কীটনাশক, পরিবশের ক্ষেত্রেও যতটা খারাপ, তেমন মানুষের ক্ষেত্রেও। আর এমন কীটনাশক লাগাতার ব্যবহারের ফলে, মশাদের মধ্যেও একটা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হচ্ছে। ফলে, সমস্ত কীটনাশকে কাজ হয় না। অগত্যা ভবিষ্যতের কথা ভেবেই, এই ভালো মশার বাহিনী তৈরি করা হয়েছে।
এই মশার ব্যবহার ইতিমধ্যে ১৪টি দেশে শুরু হয়েছে। এই মশা ফার্মিংয়ের জন্য একটি আদর্শ ল্যাবের প্রয়োজন পড়ে। যা প্রাথমিকভাবে একটু ব্যয় সাপেক্ষ। কিন্তু এই ল্যাব তৈরি হলে, বাৎসরিক হিসেব কষলে দেখা যাবে, মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছর যে পরিমাণ খরচ হয়, তার থেকে খরচ অনেকটাই কমবে।
সিঙ্গাপুর, আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা এমনকী ভারতের কিছু অংশে শুরু হয়েছে এর কাজ। অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পুদুচেরিতে তৈরি হয়েছে ওয়ালবাচিয়া ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত মশার গবেষণা কেন্দ্র। যদিও ভারতে এখনও পুরোদমে এই মশাকে বাহিনী হিসেবে বানানোর পরিকল্পনা করা হয়নি।