জটিল অঙ্কে সহজ খেলা, চব্বিশে বিজেপি শিবিরে কালবেলা!
অশান্ত হয়ে উঠতে পারে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি

The Truth of Bengal: সামনের বছর দেশের সাধারণ নির্বাচন, তার আগে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। ঠিক তার আগেই, একটি তাস খেলে দিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। আস্তিনে এই তাসটি খেলার পিছনে এক জটিল সমীকরণ রয়েছে। কারণ এই সমীকরণের খেলাকেই বারবার এড়িয়ে যেতে চাইছিল বিজেপি। জাতি ভিত্তিক জনগণনা।
জাতিগত জনসমীক্ষা নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই লড়াই চালিয়ে আসছেন নীতীশ কুমার। প্রথম পাটনা হাইকোর্ট এই সমীক্ষাকে বাতিল ঘোষণা করে, পরে ডিভিশন বেঞ্চ অবশ্য তাতে ছাড়পত্র দেয়। বিষয়টি সুপ্রিমকোর্টে এখনও বিচারাধীন হলেও, ডিভিশন বে়ঞ্চের রায়ে যেহেতু স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়নি, তাই ফাঁকতালে বাজি মেরেই দিলেন নীতীশ। বলা যেতে পারে, জাতি ভিত্তিক জনগণনায় যেখানে বারবার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল বিজেপি, এবার সেই ফাঁকেই পড়ল কেন্দ্রের শাসক দল।
আশঙ্কা যেখানে ছিল…
২০১১ সালে শেষ জনগণনা হয় আমাদের দেশে। দাবি উঠেছিল, জাতি ভিত্তি বিশেষ করে ওবিসি সংক্রান্ত জাতি গণনা করা হোক। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়েই নিমরাজি বিজেপি। জাতিভিত্তিক জনগণনা করবে না বলেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। হিসেব বলছে, ২০২১ সালে জনগণা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দুবছর কেটে গেলেও তা করা হয়নি। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে জনগণনা হওয়া সম্ভবও নয়। কিন্তু ওবিসি সংক্রান্ত জনগণনা নিয়ে কীসের সিঁদুরে মেঘ দেখছে বিজেপি? রাজনৈতিকমহলের মত, ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংয়ের আমলে যে কালো ছায়া নেমে এসেছিল, তা ফের একবার নেমে আসতে পারে। অশান্ত হয়ে উঠতে পারে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৮০ সালে দেশের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনজাতিদের জন্য বিশেষ কোটার দাবি উঠেছিল, তপশিলী জাতি, উপজাতিতো আগেই সংবিধানে জায়গা পেয়েছিল, তারপরেও একটা অংশ দাবি তুলেছিল বিশেষ সংরক্ষণের।
১৯৭৯ সালে জনতা পার্টির সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি দেশাই, তাঁর আমলেই গঠিত হয় মণ্ডল কমিশন। কমিশনের প্রধান ছিলেন বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপি মণ্ডল। সমাজের অনগ্রসর। সেই রিপোর্টে দাবি তোলা হয়, ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য। ১৯৮০ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এই রিপোর্ট দেখার পরেই, বলে এটি আসলে ‘ক্যান অফ ওয়ার্ম’ অর্থাৎ পোকার পাত্র। এটি লাগু হলেই দেশের ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। প্রায় ১০ বছর চাপা থাকে এই ইস্যু। যদিও ১৯৯০ সালে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহির করতে সেই পোকার পাত্র খুলেই ফেললেন। লাগু করে দিলেন মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ।
ভিপি সিংয়ের এই পদক্ষেপে দেশের রাজনৈতিক দিশা এক অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করল। রাজীব গান্ধী যে আশঙ্কা করেছিলেন, সেটাই হল, দেশের মণ্ডল কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে বিরোধ শুরু হল। দিল্লিতে গায়ে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ করল শতাধিক যুবক। কিন্তু যে আগ্নেয়গিরিকে ফাটানো হয়েছিল, তা থেমেছে স্রেফ সময়ের হাত ধরে। কিন্তু ভিপি সিং যে ক্ষত দিয়েছিলেন তা রয়েই গেল। যদিও একাংশ বিশ্লেষকদের মত, ভিপি সিং যে সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছিলেন এবং মণ্ডল কমিশনকে লাগু করে সমাজের একটা বড় অংশের পিছিয়ে পড়া মানুষদের সামাজিক উন্নয়নের রাস্তা দেখিয়েছিলেন, তা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
দেশে সংরক্ষণ নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের ৭৫ বছর পরেও কি সংরক্ষণ প্রয়োজন? আর সেটা প্রয়োজন হলে, সেটা কি জাতি ভিত্তিক প্রয়োজন? নাকি আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য প্রয়োজন? একাংশ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকদের মত, দেশের সংবিধান রচনার সময়ই বিশেষ কিছু জনজাতির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেটি যেমন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তেমন জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রেও। পঞ্চায়েত থেকে সংসদের আসন বহু ক্ষেত্রেই সংরক্ষণ করা হয়েছে। তারপরেও সেই অঞ্চলের জনজাতিদের আর্থসামাজিক পরিবর্তন যা হয়েছে, তা খুব একটা আশানুরূপ নয়। এখানেই ওঠে প্রশ্ন, তাহলে জাতিগত সংরক্ষণের প্রয়োজনিয়তা কোথায়? আবার একটা অংশের মত, যে সমস্ত জনজাতি কয়েক শতাব্দী ধরে বঞ্চিত, তাদের সংরক্ষণ আরও বেশি করে প্রয়োজন।
নীতীশের হাতে রাজনীতির ব্রহ্মাস্ত্র
২ অক্টোবর জাতিগত সমীক্ষা রিপোর্ট যা পেশ করেছেন নীতীশ সরকার। তা বেশ চমকে দেওয়ার মতো। রিপোর্টের তথ্য বলছে, বিহারে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং চূড়ান্ত অনগ্রসর শ্রেণি মিলিয়ে মোট ৬৩ শতাংশ জনজাতি রয়েছে। এই অঙ্কটাই চমকে দেওয়ার মতো। বিহারের মোট জনসংখ্যা রয়েছে ১৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ। এবার একটা পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক, যার রেফারেন্স দেওয়া হল একটি আর্থিক ম্যাপে। পরিসংখ্যান বলছে, কোনও রাজ্য যদি একশো টাকা আয়কর দেয়, তাহলে রাজ্যগুলি উন্নয়নের জন্য কতটাকা কেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকে। ম্যাপের হিসেব বলছে, সবচেয়ে বেশি টাকা কেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকে উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি।
স্বাভাবিক, কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিটেফোঁটা সেভাবে কিছুই পায়নি। প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হল, বিহারের অঙ্ক নিয়ে। চব্বিশের নির্বাচনের আগে, তুরুপের তাসটি খেলেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। সমর্থন জানিয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব, দুজনেই কয়েকদশক ধরে বিহারে রাজত্ব করছেন। এদিকে ম্যাপের পরিসংখ্যান বলছে, বিহার থেকে যদি একশো টাকা আয় উঠে আসে, তার বিনিময়ে তারা কেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকে ৯২২ টাকা। যেখানে পশ্চিমবঙ্গ পায় মাত্র ৯০ টাকা।
এখানেই উঠে আসে প্রশ্ন, বিহার যে টাকা কর আদায় করে তার প্রায় ৯ গুন টাকা কেন্দ্র থেকে পেয়ে থাকে। আর এটা আজকে নয়, গত কয়েক দশক ধরেই পেয়ে আসছে। এর পরেও অনগ্রসর শ্রেণি ও চূড়ান্ত অনগ্রসর শ্রেণির সংখ্যা এতো বিপুল মাত্রায় থাকে কী করে? অথচ বিহারই একটা সময় ছিল প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের রাজধানী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, কয়েকদশক ধরে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের শাসকেরা শাসন করেছেন, যে অর্থ কর হিসেবে তুলেছে, তার কয়েক গুন অর্থ কেন্দ্র থেকে পেয়ে এসেছে এবং আসছে, তারপরেও ৬৩ শতাংশ জনজাতির সংরক্ষণ প্রয়োজন!
সময়ে বদলায় সমীকরণ
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, জাতিগত রাজনীতি থেকে কিছুটা সরতে শুরু করেছিল কংগ্রেস। তাঁদের মধ্যে অন্যতম রাজীব গান্ধী। তারপরেও কয়েকটা দশক একই আদর্শের পথেই হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু চব্বিশের নির্বাচনকে মাথায় রেখে, জাতিগত রাজনীতিতেই সায় মেলাতে দেখা যাচ্ছে। নীতীশের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে কংগ্রেস এমনকী, রাজস্থান কর্ণাটকেও জাতিগত সমীক্ষা চালানোর পক্ষে সায় দিয়েছে। শুধুতাই নয়, যে রাজ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি রয়েছে, তাদের কাছেও জাতিগত সমীক্ষা চালানোর আহ্বান জানিয়েছে কংগ্রেস। কারণ ভোট বড় বালাই, আর ভোটের জন্য নম্বর, অর্থাৎ ভোটব্যাঙ্ক বড় ফ্যাক্টর। বিহার থেকে সেই সূচনা করে দিলেন নীতীশ। এখন দেখার, এই জটিল অঙ্কের খেলায় বিজেপি কতটা সামলাতে পারে!