সস্তা দামে চিকেন স্টু কিংবা পাউরুটি আর ঘুগনি? ওয়াইএমসিএ-র বিখ্যাত ক্যান্টিন
YMCA's famous canteen

The Truth of Bengal: কটা সাদা কাগজ লাগানো পিচবোর্ডটা ঝুলছে দেওয়াল থেকে। কলেজ স্কোয়ার শেষ হয়ে হিন্দু স্কুলের দেওয়াল একটা শুরু হওয়ার ঠিক আগের দেওয়ালে। বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ কোনও পুরোনো বাক্সে পুরোনো প্রেমের কোনও চিহ্ন খুঁজে পেলে যেমন হয় আর কী! করোনা ভাইরাসের এই অতিমারি, এই বিধিনিষেধের পৃথিবীতে কি আবার কলেজ স্ট্রিটে ফিরে এল ওয়াইএমসিএ-র ক্যান্টিন? আবার কি পাওয়া যাবে অকল্পনীয় সস্তা দামে সেই চিকেন স্টু আর রুটি? কিংবা পাউরুটি আর ঘুগনি? বিজ্ঞপ্তিকে অনুসরণ করে কলেজ স্কোয়ারের শেষ প্রান্তের চিচিং ফাঁক দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে গিয়েই দেখি দিব্যি চালু হয়ে গিয়েছে ওয়াইএমসিএ-র সেই বিখ্যাত ক্যান্টিন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উলটোদিকে যে আসলেই কলেজ স্ট্রিট পাড়ার একটা ল্যান্ডমার্ক। আমাদের মতো যাদের কৈশোর, যৌবনের বড় অংশই কলেজ স্ট্রিটে কেটেছে, তাদের কাছে কলেজ স্ট্রিটের এই ওয়াইএমসিএ ক্যান্টিনের নস্টালজিয়াই আলাদা। কফি হাউসের ইনফিউশন, থুড়ি ব্ল্যাক কফি আর প্যারামাউন্টের শরবতের মতোই টাইম মেশিনে চড়ে হারানো অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে স্কুলে পড়ার সময় যে হারানো মানিকের সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম, তা যদি যুগের ব্যবধানে আবার ফিরে আসে, এবং একই রকম স্বাদ, গন্ধ নিয়ে অনুভূতিকে ধাক্কা দেয়, তাহলে ভাল লাগে বই কি! স্কুলে খেলার পর টিফিনের জন্য কিংবা কলেজে কাউকে চমকে দিতে ওয়াইএমসিএ-র এই ক্যান্টিন ছিল অব্যর্থ দাওয়াই। এত সস্তায় ভাল খাবার এবং পেট ভরার আয়োজন আর কোথাও পাওয়া যেত না।
আসলে দুনিয়া জুড়ে এটাই বোধহয় যে-কোনও ওয়াইএমসিএ-র ট্রেডমার্ক, সস্তা ও পুষ্টিকর! কলকাতার চৌরঙ্গি হোক কিংবা নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন, ওয়াইএমসিএ, যে-কোনও হোস্টেল বা ক্যান্টিনের চরিত্রগুলো একরকমই। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা কলকাতায় আসেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ধর্মতলার ওয়াইএমসিএ চেনেন। এবং থাকেনও হয়তো। চৌরঙ্গি পাড়ায় ওইরকম সস্তায় থাকার এবং গাড়ি- বারান্দার উপর রেস্তোরাঁ আর নেই। এমন গাড়ি বারান্দা যেখানে বসে কফিতে চুমুক কিংবা ফিশ ফ্রাই খেতে খেতে ধর্মতলার ভিড় থেকে সামনের ময়দান, সবই দেখা যায়। ধর্মতলার ওয়াইএমসিএ-ও তাই কলকাতার একটা ল্যান্ডমার্ক, সেইসব হারানো দিন এবং সোনালি অতীতের স্মৃতিকে বহন করে যখন চৌরঙ্গির গাড়ি-বারান্দাওয়ালা রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়াদাওয়া করাটা শৌখিনতার নজির ছিল। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী হিসেবে প্রায় ১৫০ বছর কাটিয়ে দেওয়া কলকাতার শরীরে এবং মনে এখনও যেসব সাহেবি আমলের চিহ্ন লেগে রয়েছে, ওয়াইএমসিএ তার মধ্যে অন্যতম। এই শহরের সঙ্গে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নাড়ির টানকে যেমন বারবার মনে করিয়ে দেয় অঞ্জন দত্তর গান আর বৌবাজারের বো ব্যারাকে বড়দিনের সন্ধ্যা, তেমনই শহরের ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা ওয়াইএমসিএ-র হোস্টেল, গেস্টহাউস কিংবা ক্যান্টিন।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া রিক চার্লসওয়ার্থ-এর মতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা যেমন অস্ট্রেলিয়াকে হকিতে সুপার পাওয়ার বানিয়েছিল, তেমনই এখনও এই ওয়াইএমসিএগুলো কলকাতাকে আন্তর্জাতিক করে রাখে, এই শহরটাকে বিশ্বের সঙ্গে জোড়ে। কেমন ভাবে ওয়াইএমসিএ বিশ্বের সঙ্গে জোড়ে? আমার বন্ধু, একদা বহু অ্যাসাইনমেন্টে আমার রুমমেট, কিন্তু কিছুদিন আগে শ্রীনগরে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়ে কবরে শুয়ে থাকা সাংবাদিক বন্ধু সৈয়দ সুজাত বুখারির একটা গল্প বলতে পারি। কাশ্মীরের এই সাংবাদিক সম্পাদক একবার লন্ডনে কোনও আলোচনা সভায়, আমিও লন্ডনে পৌঁছে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হতবাক। দেখি ওয়াইএমসিএ-র হোস্টেলে উঠেছে সুজাত। যেমন চমৎকার রুম আর তেমনই দারুণ খাবার। লন্ডনে বৃষ্টিভেজা দিনে ওয়াইএমসিএ-তে কফি খেতে খেতে শুধোলাম, কীভাবে এইরকম একটা দারুণ জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করল সুজাত? হাসতে হাসতে ‘রাইজিং কাশ্মীর’-এর প্রাক্তন সম্পাদক যে কথাটা বলেছিল, সেটা এখনও আমার মাথায় গেঁথে আছে। দিল্লিতে কনট প্লেস-এ আমার সঙ্গে গিয়েই ও যে ওয়াইএমসিএ-র মেম্বারশিপ নিয়েছিল, সেটাই সুজাত বুখারিকে খাস লন্ডনে ওইরকম দারুণ থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।ওয়াইএমসিএ আসলেই আমাদের আন্তর্জাতিক হওয়ার পাসপোর্ট।