SIR কি সংবিধানের অন্তরাত্মার বিরোধী: বিতর্ক, প্রেক্ষাপট ও আশঙ্কা
এই প্রক্রিয়া ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনীর দাবি রাখলেও, এর আইনি ভিত্তি, বাস্তব প্রয়োগ ও রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তন্ময় ঘোষ: ভারতের একাধিক রাজ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ-সহ মোট বারোটি রাজ্যে নির্বাচন কমিশন স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর চালু করেছে। এই প্রক্রিয়া ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনীর দাবি রাখলেও, এর আইনি ভিত্তি, বাস্তব প্রয়োগ ও রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
হঠাৎ এসআইআর কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? এর সাংবিধানিক ভিত্তি কী? ‘দি রিপ্রেজেন্টেশন অফ দি পিপলস অ্যাক্ট ১৯৫০’ এবং ‘রেজিস্ট্রেশন অফ ইলেক্টোরালস রুল ১৯৬০’ অনুসারে ২১ নম্বর ধারায় নিবিড় সংশোধনী (ইনটেনসিভ রিভিউ), সারসংক্ষেপ সংশোধনী (সামারি রিভিশন ও অংশত নিবিড় (পার্টলি ইনটেনসিভ) বা অংশত সামারি (পার্টলি সামারি) বলা আছে, কিন্তু ‘স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ নামে একত্রিত কোনও ধারণা রুলে নেই। অর্থাৎ এসআইআর মূলত তিনটি ভিন্ন ধারার উপাদান জুড়ে নতুনভাবে তৈরি একটি পদ্ধতি, যা নিয়েই বিতর্কের সূচনা। এর উৎস বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হয় সংবিধানের ৩২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে, যেখানে নির্বাচন কমিশনকে বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হলেও সেই ক্ষমতা যে সীমাহীন নয়, তার উল্লেখ সংবিধানেও আছে এবং সুপ্রিম কোর্টও সেটা বারবার উল্লেখ করেছেন।
আইনি প্রশ্ন ছাড়াও সবচেয়ে বড় উদ্বেগ তৈরি করেছে এসআইআর-এর বাস্তব প্রয়োগ। জাতীয় নির্বাচন কমিশন নিজেই যে এপিক ভোটার কার্ড ইস্যু করেছে, সেটাকেই আবার প্রমাণ হিসেবে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ জন্মদাতা নিজের সৃষ্টিকেই অস্বীকার করছে। এ এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। আধারের ক্ষেত্রেও একই দ্বৈত নীতি; একদিকে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কিছুতে আধারকে বাধ্যতামূলক করেছে। আবার অন্যদিকে এসএইআর-এ তার স্বীকৃতি নিয়ে সংশয়। এই দ্বিমুখী নীতি পুরো পদ্ধতির উদ্যেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়। সাধারণ মানুষের হাতে রেশন কার্ড, জব কার্ড বা আধারই প্রধান পরিচয়পত্র— এই নথিগুলিই যখন অস্বীকৃত হওয়ার সম্ভাবনায় থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ বাড়ে।
সবচেয়ে গুরুতর বিষয়— এসআইআর-কে নাগরিকত্বের সঙ্গে যুক্ত করার প্রবণতা। নির্বাচন কমিশনের কাজ ভোটার তালিকা তৈরি, সংশোধন এবং ভোট পরিচালনা করা। কোনও ভাবেই নাগরিকত্ব নির্ধারণ নয়। কারণ সেটা তাদের অধিকারের বাইরে। নাগরিকত্ব ঠিক করার অধিকার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। অথচ আশ্চর্য জনক ভাবে জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় নাম বাদ যাওয়ার সঙ্গে নাগরিকত্বের কথা বলছে, আবার কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, ‘ডিটেক্ট, ডিলিট, ডিপোর্ট’, মানে তারা আবার এসএইআর-কে নাগরিকত্বের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে। সংবিধান স্বীকৃত দুটো আলাদা সংস্থা এই পুরো প্রক্রিয়াকে বিপজ্জনকভাবে এক সুতোয় বাঁধছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের প্রান্তিক মানুষজন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা শিশু, কিংবা যাদের বাবা-মায়ের পরিচয় নেই তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে অযাচিত সঙ্কট এবং আতঙ্ক দুইই তৈরি হচ্ছে। যা সরাসরি ভারতীয় সংবিধানের অন্তরাত্মার বিরোধী।
সংবিধানের ৩২৫ নং অনুচ্ছেদে পরিষ্কার ভাবে লেখা আছে, ‘‘সার্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষার ভিত্তিতে কোনও বৈষম্য করবে না, সকল নাগরিকের অংশগ্রহণে সরকার গঠন হবে।’’
ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আশা রাখি, জাতীও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এবং সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। কিন্তু তাদের ক্রমাগত পক্ষপাতমূলক আচরণ এই ভিতটাই নাড়িয়ে দিচ্ছে।
এদিকে সেনসাস অর্থাৎ জনগণনা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কোনও জনমিতির পরিবর্তন বা জনবিন্যাস যাচাই করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ এসআইআর ঘোষণা এবং তাকে ঘিরে একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের উদ্বাহু নৃত্য পুরো বিষয়টাকে ঘিরেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠছে স্বাভাবিকভাবেই। পদ্ধতি শুরুর আগেই কল্পনায় কোটি মানুষ বাদ পড়ার নিদান। এর সঙ্গে সিএএ-কে জুড়ে দেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে ভীতির সঞ্চার করেছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটার তালিকা হওয়া উচিত অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক; মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই যেখানে লক্ষ্য। কিন্তু এসআইআর পদ্ধতি মানুষের মধ্যে ভয়, বিভ্রান্তি ও অনাস্থা বাড়াচ্ছে বলেই আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। গণতন্ত্রের মূল মূল্যবোধ রক্ষার স্বার্থে স্বচ্ছতা, বৈষম্যহীনতা ও আইনসঙ্গত প্রক্রিয়াই এখন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ। এত কিছুর পরেও ভারতবর্ষের প্রতিটি বৈধ নাগরিকের ‘‘কাগজ দেখাবো না’’ বলাটা কি অপরাধ?






