মহানায়ক উত্তম কুমার যেতেন ৬২০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে, জানেন কোথায়
Mahanayak Uttam Kumar used to visit this 620-year-old temple, do you know where it is?

Truth Of Bengal: তরুণ মুখোপাধ্যায়: দীর্ঘ ৬২০ বছর ধরে রিষড়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা সিদ্ধেশ্বরী ভক্তি ভরে পূজিত হয়ে আসছেন। এককালের ষষ্ঠীতলা অধুনা রিষড়ার এনকে ব্যানার্জি স্ট্রিটের উপর অবস্থিত মায়ের অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরে প্রতিদিন আগমন ঘটে অগণিত ভক্তের। মানুষ পুজো দিয়ে প্রার্থনা করে যান মায়ের কাছে। ভক্তদের বিশ্বাস মায়ের কাছে কেউ যদি তাদের মনের বাসনা পূরণের জন্য কায়মন বাক্যে ভক্তি ভরে প্রার্থনা করেন দেবী সিদ্ধেশ্বরী কখনোই তাদের ফেরার না, নিরাশ করেন না। ভক্তের ডাকে সাড়া দেন তিনি।
এখানকার সিদ্ধেশ্বরীর মায়ের বহু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী রয়েছে এই মন্দির। শুধু হুগলির বিভিন্ন জায়গা নয়, মায়ের মাহাত্বের কথা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। প্রায় প্রতিদিন প্রচুর পুণ্যার্থী দেবী সিদ্ধেশ্বরীর আশীর্বাদ নিতে। সিদ্ধেশ্বরী মাতার মাহাত্ম্য সম্বন্ধ বলতে গিয়ে মা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, মায়ের আবির্ভাব সম্বন্ধে জানা যায় ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলা থেকে জটাধর পাকড়াশি নামে এক সাধক রিষড়ার পশ্চিম প্রান্তের মোরপুকুর অঞ্চলের বাসিন্দা দুর্গাচরণ ঘোষের বাড়িতে আসেন।
যেহেতু জটাধর ছিলেন ভক্তপ্রাণ মানুষ, তাই তৎকালীন রিষড়ার প্রাকৃতিক শোভা এবং এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত মা গঙ্গা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি গঙ্গাস্নানে যেতেন। পরবর্তীকালে জটাধর পাকড়াশী মোরপুকুর থেকে বর্তমান মন্দির যেখানে রয়েছে সেই অঞ্চলে ঘোষ পরিবারের কাছ থেকে কিছু জমি দান স্বরূপ পান এবং সেখানেই তিনি একটি কুটির স্থাপন করে সাধন ভজন করতে থাকেন। মা সিদ্ধেশ্বরী প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে যে জনশ্রুতি আছে তা থেকে জানা যায় ৮১১ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির সংলগ্ন একটি পুকুর থেকে একটি ঘট ভেসে ওঠে।
সেই ঘট স্থাপনের পর ভক্ত জটাধর মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছ থেকে এক স্বপ্নাদেশ পান এবং মা তাকে আদেশ করেন পুকুর থেকে সেই ঘটের উপর তাঁর মূর্তি স্থাপন করে পুজো-অর্চনা শুরু করার জন্য। সেই আদেশ মতো মায়ের হাস্যমুখী মাটির মূর্তি ৮০১ বঙ্গাব্দে যথাযথ ভাবে স্থাপন করেন ভক্ত জটাধর। স্বপ্নাদেশে মৃন্ময়ী মূর্তির নিম্নাংশ দৃশ্যমান ছিল না এর সঙ্গে দিক তার জীবও ছিল না, সেই মূর্তি স্থাপন করে শুরু হয় মা সিদ্ধেশ্বরী পুজো-অর্চনা। এরপর ১১৭৭ বঙ্গাব্দে তদানীন্তন বাংলার নবাব মায়ের সেবার জন্য ১৮ বিঘা জমি দান করেন। সেখানেই তৈরি হয় মন্দির। পরবর্তীকালে কালীমন্দির সংলগ্ন স্থানে একটি ভোগের ঘর নির্মাণ হয়।
১৩৬৫ বঙ্গাব্দে মায়ের মন্দিরের সামনে নাট মন্দির তৈরি হয় এবং ১৩৭১ বঙ্গাব্দে সাধারণ রিষড়াবাসীর অর্থে নবচূড়া বিশিষ্ট এবং মর্মর ফলকে আচ্ছাদিত মায়ের মন্দির নুতন ভাবে স্থাপিত হয়। এর আগে ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে এক রাতে কিছু দুর্বৃত্ত মায়ের সমস্ত অলংকার চুরি করে এবং এই সময় মায়ের দক্ষিণ হস্তটি ভেঙে যায়। ১৩৩৬ সালে ১৪ই কার্তিক বাৎসরিক শ্যামা পুজোর দিন আবার নতুনভাবে মূর্তি স্থাপিত হয়। কিন্তু এরপরেও মাটির মূর্তির হাত ভেঙে যাওয়ায় মন্দির কমিটি সেবাইতরা অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন এবার মায়ের পাথরের মূর্তি তৈরি করা হবে।
সেই সিদ্ধান্ত মতো এখানে মায়ের কালো প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মায়ের মাহাত্ম্য এবং অলৌকিক ঘটনা সম্বন্ধে জানা যায় এক অসহায় মহিলার তার ১১ বছরের সন্তান হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, ব্যথিত মা এসে শরণাপন্ন হন মা সিদ্ধেশ্বরী থানে। তার চরণতলে বসে কাতর প্রার্থনা করেন যাতে তার পুত্র সন্তানটি ফিরে আসে। মা সেই পুত্রহারা মায়ের কান্না শুনেছিলেন।
মায়ের কৃপায় সুদূর নেপাল থেকে সেই হারানো ছেলেটিকে ফিরে পান তার মা। এই ধরনের একাধিক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী জাগ্রত মা সিদ্ধেশ্বরীর দেবালয়। জানা যায় বহুকাল আগে চৈত্র মাসে সন্ন্যাসীরা এসে এখানে গাজন উৎসবে যোগ দিতেন। শিব পুজো করতেন এবং শিবের নাম গানে এলাকা মুখরিত হয়ে থাকতো। এবং বান ফোঁড়ার কথাও শোনা যায়। মায়ের এই মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে অনেক সাধু সন্ন্যাসীরাও এসেছেন। এদের মধ্য জগত গুরু শংকরাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতীও এই মন্দিরে এসে সিদ্ধেশ্বরী মাকে দর্শন করে গেছেন।
এছাড়াও পাঞ্জাব থেকে ভামেশ্বরী মাতাজি এসেছেন, অখিল ভারতীয় গীতা মহামন্ডলেশ্বর শ্রীমৎ মঙ্গলানন্দ মহারাজ, এছাড়াও এখানে এসেছিলেন নিত্যানন্দ গিরি তারা নন্দ ব্রহ্মচারী প্রমুখ বিশিষ্ট সাধু সন্তগন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী ডাক্তার গোপাল দাস নাথ প্রায় এই মন্দিরে আসতেন। বাংলা রূপালি পর্দার অন্যতম জনপ্রিয় মহানায়ক উত্তম কুমারও মা সিদ্ধেশ্বরী চরণে এসে পুজো অর্পণ করে আশীর্বাদ নিয়ে গিয়েছিলেন। কালী পুজোর দিন নতুন লাল বস্ত্র পরিয়ে মার বিশেষ পুজা-অর্চনা হয় এবং এই পুজোর দিন বহু মানুষের সমাগম হয়।
সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুজোয় আগে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরে ছাগবলি হতো। এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল কালীপুজোর রাতে বলি হয় এখানে। সিদ্ধেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন বাবা মহাদেবের ওখানে একটি মন্দির রয়েছে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা প্রচুর ভক্তের সমাগম হয় এবং প্রতিদিন নিত্য অন্য ভোগ নিবেদন করা হয় সিদ্ধেশ্বরী মাকে। এরমধ্যে অমাবস্যা এবং বৃহস্পতিবার মাকে খিচুড়ি ভোগ প্রদান করা হয় এবং পূর্ণিমা এবং ষষ্ঠীর দিন মাকে লুচি ভোগ দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষজন এখান থেকে মায়ের প্রসাদ পান। এছাড়াও বিশেষ কয়েকটি দিন যেমন বাংলার নববর্ষ, অক্ষয় তৃতীয়া, অম্বুবাচী, মহালয়া, দুর্গাষষ্ঠী,দুর্গা অষ্টমী, পৌষ সংক্রান্তি, শিবরাত্রি, নীল ষষ্ঠীতে যথেষ্ট ভক্তের সমাগম ঘটে মায়ের মন্দিরে।
গ্রীষ্মকালে মায়ের মন্দিরের দরজা ভোর চারটে পঁয়তাল্লিশ খুলে দেওয়া হয় জনসাধারণ ভক্তদের দর্শনের জন্য এবং রাত ৮:১৫ মিনিটে মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়। বর্তমানে ৬৭ জন সেবাইত রয়েছে। শরিকদের সংখ্যা সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় সুষ্ঠুভাবে মন্দির পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির ট্রাস্ট রিষড়া নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয় এবং তারাই এখানকার মন্দির পরিচালনা করেন। বাংলার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে এইকম বিভিন্ন দেবদেবীর মাহাত্ম্য। যা প্রত্যক্ষ করতে দর্শন করতে ছুটে যান ভক্তের দল। সেই রকমই ৬২০ বছর ধরে রিষড়ার মা সিদ্ধেশ্বরী অলৌকিক মাহাত্ম্যতে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ভক্তদের ঢল নামে মন্দির চত্বরে।