
The Truth of Bengal: কলকাতা, তিলোত্তমা কলকাতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তৈরি প্রথম নগর ও রাজধানী। আপনাদের মনে হতেই পারে আচমকা একলাফে রাজবলহাট থেকে কলকাতায় কেন? কারণ আছে, গোটা বিশ্ব একটি কলকাতাকেই চেনে। কিন্তু এই বাংলার বুকে আরও যে কলকাতা আছে তা খোঁজ খবর রাখেন ক’জন? রাজবলহাট থেকে অনতিদূরে হাওড়া জেলায় রয়েছে কলকাতা গ্রাম। এখন প্রশ্ন এই কলকাতা বা কলিকাতা শব্দটি এলো কোথা থেকে? আর হাওড়া জেলার মধ্যেই অখ্যাত এক গ্রামের নাম কলকাতা হল কেন? এবং হল কীভাবে? হাওড়া জেলার অন্তর্গত একটি এলাকা রয়েছে রসপুর। তার পাশের রয়েছে কলকাতা গ্রাম, স্থানীয়রা অনেকেই একে রসপুর কলকাতা বলে থাকেন। আবার কেউ কেউ বড় কলকাতার থেকে আলাদা করতে ছোট কলকাতা বলেও ডেকে থাকেন।
ইতিহাস গবেষকদের দাবি, একটা সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে লন্ডন শহরের পরেই কলকাতা শহরের প্রাধান্য স্বীকৃত হত এবং তার খ্যাতিও ছিল বিশ্বব্যাপী। কলিকাতা নাম নিয়ে অনেকেই নানারকম থিওরি খাড়া করেছেন। কেউ কেউ মনে করেছেন, কলিকাতা নামের উৎপত্তি হয়েছে কালীঘাট শব্দের বিকার থেকে। কিছু গবেষক এই থিরওরির বিরোধিতা করে বলেছেন, ভাষাতত্ত্বের বিকারের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক নীতি রয়েছে, কালীঘাট থেকে কলিকাতা হয় না। সেক্ষেত্রে কালীকোট্টা বা কালী কোঠা অর্থাৎ কালীর কোঠা বা ঘর বা কালী মন্দির থেকে এই শব্দ এসেছে। যদিও আধুনিক গবেষকদের মত, এটি সম্পূর্ণ আজগুবি গোঁজামিল তত্ত্ব। কারণ কালীঘাটের পাশে কলিকাতা নামের গ্রাম অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে।
কেউ কেউ বলেন, কালীক্ষেত্র থেকে কলিকাতা, কেউবা বলেন কিলকিল থেকে কলিকাতা। যদিও এগুলি সবই অতি কল্পনাপ্রসূত তত্ত্ব। আধুনিক ইতিহাস গবেষক ও ভষাতত্ত্ববিদেরা মিলে অবশেষে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ। সেটি হল, কলিকাতা একটি খাঁটি শব্দ। এর অর্থ কলি বা কলিচূনের জন্য কাতা বা শামুকপাড়া। সুতার নুটী বা গোলার হাট বা আড়ত থেকে যেমন সুতানুটী নাম। এবং চুনের কারখানা থেকেই কলিকাতা নাম। ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের এক ছাত্র, বাংলা দেশের গ্রামের নাম নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাঁর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলায় মোট তিনটি কলিকাতা গ্রামের নাম পাওয়া যায়। একটি বর্তমানে মহানগরে পরিণত হয়েছে, অন্যদুটির মধ্যে একটি রয়েছে ঢাকা জেলার লৌহজঙ্গ থানা এলাকায় আর দ্বিতীয়টি রয়েছে হাওড়ার আমতা থানা এলাকায়। অর্থাৎ এই গ্রামগুলিতে একটা সময় শামুক পুড়িয়ে কলিচুন তৈরি করা হত। সেই থেকেই নাম হয় কলিকাতা। হাওড়ার ছোট কলিকাতাও যে কলিচুন প্রস্তুতের গড় ছিল, তার প্রমাণ আজও রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, একটা সময় রসপুরের এই কলিকাতা গ্রাম বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল। দামোদরের তীরে এই অঞ্চলে অন্যতম প্রধান কলিচুন তৈরি ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। চুনারীদের বাসও ছিল অনেক। স্থানীয়দের থেকে জানা যায়, এই কলিচুন তৈরি হত, একদম ভিন্ন পদ্ধতিতে। শামুক ধুয়ে নিয়ে পণের মধ্যে সাজিয়ে দেওয়া হয়। শামুক পোড়াবার জন্য বড় বড় মাটির পণ তৈরি করা হয়। তলায় হাঁড়ি উপুড় করে সাজানো। তার উপর ঘুঁটে পাতা দিয়ে সাজানো হয়, তার উপর শামুকগুলি সাজিয়ে আগুন দেওয়া হয়। পোড়ানোর পর শামুক পরিষ্কার করে, তলামাথা বাদ দিয়ে, কেবল মাঝখানটা নিয়ে একটা জলের ডাবায় সামান্য চিটেগুড় দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ফুটিয়ে গুঁড়ো করে নেওয়া হয়। ছোট কলিকাতা বর্তমানে কোনও জনপ্রিয় জায়গা না হলেও, একটা সময় যে সমৃদ্ধ গ্রাম ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, তা আন্দাজ করা যায়। এই অঞ্চলে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির অবশিষ্ট রয়েছেতার মধ্যে অন্যতম ধর্মরাজের মন্দির, কালীমন্দির।