সাত দশক পেরিয়ে ভাষা সংগ্রাম আজ মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার অভিজ্ঞান
After seven decades of language struggle today people experience respect for their mother tongue

The Truth of Bengal, Mou Basu : সাত দশক পেরিয়ে ভাষা সংগ্রাম আজ দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার অভিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু চিহ্নিত এই দিনটি (২১ ফেব্রুয়ারি) তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পেরোতে হয়েছে আরও ৪ দশক। যতদিন না ১৯৯৯ সালে রফিকুল ইসলাম বুকে সাহস ও মনে ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞা ও সংকল্প নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে। মূলত, রফিকুল ইসলামের উৎসাহ প্রতিজ্ঞার অঙ্গীকারেই পরবর্তী সময় সম্ভব হয়েছে এই দিনটির উদযাপন। নামের মধ্যেও আছে এই সমাপতনের ছায়া। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা আদায়ের জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ বলিদান দেন সালাম, বরকত, জব্বর ও রফিকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ পড়ুয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ পড়ুয়া মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার জন্য যে লড়াই, আত্মবলিদান দেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রাখেন কানাডার ভ্যানকুভার শহরের রফিকুল ইসলাম আর আবদুস সালাম।
মানুষ যাতে নিজেদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝে, মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন হয়, তার সম্মানরক্ষায় সক্রিয় হয়, তার জন্য কাজ করে চলেছে ‘আ গ্রুপ অফ মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ তথা ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’। এঁদেরই উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বার্সেলোনা অধিবেশনে ভাষার অধিকারকে ‘বিশ্বজনীন অধিকার’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই সংস্থারই অন্যতম সদস্য রফিকুল ইসলাম। মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছিল, কী ভাবে রফিক-সালাম-বরকতরা নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন, তার বিশদ তথ্য জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানকে ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি একটি প্রস্তাব পাঠান রফিকুল। ওই প্রস্তাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবটিতে পৃথিবীর সাতটি দেশের দশ জন ভাষাপ্রেমিকও সই করেন। এঁদের মধ্যে এক জন হলেন বাংলাদেশের সাহিত্যিক আবদুস সালাম। তিনি সে সময় রাষ্ট্রসংঘের চিফ ইনফরমেশন সেক্রেটারি ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর নজরে আসে প্রস্তাবের আকারে ওই চিঠি। রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্য কোনো সদস্যরাষ্ট্রের কাছ থেকে যাতে একই ধরনের প্রস্তাব আসে তার জন্য উদ্যোগী হতে হাসান ফিরদৌস ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি ওই ভাষাপ্রেমিকদের অনুরোধ করেন। সেই সময় ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’ থেকে এক জন জার্মানভাষী, এক জন ইংরেজিভাষী, এক জন স্প্যানিশভাষী এবং এক জন ক্যান্টোনিজভাষী ওই একই প্রস্তাব চিঠি আকারে কোফি আন্নানের কাছে পাঠান। ওই চিঠির একটি কপি পাঠানো হয় রাষ্ট্রসংঘের কানাডার রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও।
হাসান ফিরদৌস পরের বছর রফিক-সালামদের বলেন, তাঁরা যেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোসেফ পড-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তিনি ইউনেস্কোর অ্যানা মারিয়ার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে বলেন। সেইমতো মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন রফিক-সালামরা। রফিক-সালামদের বক্তব্য আগ্রহের সঙ্গে শোনেন মারিয়া, প্রস্তাবটি পড়েন এবং এই প্রস্তাব কানাডা, ভারত, বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, স্পেন ও ফিনল্যান্ডের মাধ্যমে পেশ করার পরামর্শ দেন। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের কাছে ওই প্রস্তাবটি পেশ করা হয় ‘বিশ্ব মাতৃভাষাপ্রেমী সংস্থা’র তরফে। ফলে আরও অনেকে যুক্ত হন সেই কর্মকাণ্ডে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বাংলাদেশের তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী এম এ সাদেক, শিক্ষাসচিব কাজী রফিকুদ্দিন, অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের তৎকালীন অধিকর্তা মশিউর রহমান, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোজাম্মেল আলি, ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান উপদেষ্টা তোজাম্মেল হক প্রমুখ। তাঁরা তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে পৃথিবীর আরও ৩০টি দেশের প্রতিনিধিদের প্রস্তাবটি সমর্থন করার জন্য রাজি করান। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর সম্বলিত প্রস্তাবটি বিশ্বের ৩০টি দেশের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রসংঘে পাঠানো হয়। ১৯৯৯ সালে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাবটি ১৮৮টি দেশ সমর্থন করে। ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়।
FREE ACCESS