কলকাতা

জাস্টিস সবার অন্তরের কামনা, কিন্তু চিৎকৃত উল্লাসে তা প্রকাশ পেলেই কি তার সার্থকতা?

Justice is the desire of everyone's heart, but what is its worth if it is expressed in written joy

Truth of Bengal,জয়ন্ত চক্রবর্তী: গড়িয়াহাট থেকে যে রাস্তাটা গোল পার্কের দিকে গেছে, যে রাস্তা আমোদিত হয় দাস কেবিন এর বিখ্যাত মোগলাই পরোটার ম ম করা গন্ধে, সেই রাস্তাতেই ইমিটেশন গয়নার দোকান তারক ঘোষের। গড়িযার মহামায়াতলা থেকে নাকে মুখে গুঁজে প্রতিদিন সকাল ন’টা নাগাদ দোকান খোলেন। আর বন্ধ করতে করতে রাত দশটা। মাঝের তেরোঘন্টায় মানিকের দোকানের চা আর কোয়ার্টার পাউন্ড রুটি ঘুগনি ভরসা। সারা বছর তারক তাকিয়ে থাকেন দুর্গা পুজোর মার্কেট এর দিকে। সম্বছরের খাই খরচাটা উঠে যায় এই পুজোর মরশুমে।

এবারের পুজোর কেনাকাটায় দুর্দান্ত হতাশ তারক। হতাশা গোপন করলেন না–এবার মার্কেট খুব খারাপ! উই ওয়ান্ট জাস্টিস এর ঠেলায় মানুষ ঘরে ফিরবে কখন সেই ভাবনায় অস্থির। কেনাকাটা করবে কখন? আমাদের মত ছোট ব্যবসায়ীদের পালে বাঘ পড়েছে। গড়িয়াহাট চত্বরে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর কাছে খোঁজ নিন। সবারই বিক্রি বাটার অবস্থা সঙ্গীন। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে –আমাদের জাস্টিস টা কে দেবে? বণিক সংস্থা আসোচেম কয়েক বছর আগে হিসাব দিয়েছিলো যে কলকাতার দুর্গাপুজো ধরে গোটা বাংলায় দুর্গাপুজো উপলক্ষে বেয়াল্লিশ হাজার কোটি টাকার আদানপ্রদান হয়।

সংখ্যাটি এই ক’বছরে দ্বিগুন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সারা বছরের অর্থনীতির চাকা ঘোরে এই পুজোর বাজারকে কেন্দ্র করে। এবার আরজি করের নারকীয় ঘটনার জেরে উই ওয়ান্ট জাস্টিস এর দৌলতে পুজোর বাজারের দফা রফা। আর জি করের ঘটনার বিচার কে না চায় — তাই বলে বাংলার সেরা অর্থনৈতিক উৎসবের পিছনে ছুরি মেরে? ডেকোরেটর, আলোর যোগানদার, ইভেন্ট ম্যানেজার, ফুল এর কারবারি, প্রতিমা শিল্পী থেকে আরম্ভ করে কত না ব্যাবসায়ীর মাথায় হাত।

কদিন আগে সিটি কেবল এর কর্ণধার সুরেশ শেঠিয়া বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেল এর মার্কেটিং প্রধান আক্ষেপ করছিলেন — ফিল্মস্টাররা সবাই পুজোয় চ্যানেলে আসার জন্যে অগ্রিম নিয়েও জানাচ্ছেন – পুজোর আগে পরিবেশ কেমন থাকে তাই দেখে তাঁরা আসার সিদ্ধান্ত নেবেন। নয়তো এবারটির মত ছেড়ে দিতে হবে।

ওই অনুষ্ঠানেই এক বাঙালি ব্যাবসায়ী বলছিলেন–পুজোর বাজারের এই হাল সারা বছর নিম্নবিত্ত নয়, উচ্চবিত্ত নয় – মধ্যবিত্তদের সমস্যায় ফেলবে। কথাটা তিনি কিছু ভুল বলেননি–তবে নিম্নবিত্তরাও সমস্যায় পড়বে। মা দুর্গার শাড়িতে যে সলমা জরির কান থাকে তা যোগায় বর্ধমান এর একটি গ্রাম। অখ্যাত এই গ্রামটিতে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। বোসপুকুর শীতলা মন্দির এর বিখ্যাত ভাঁড়ের পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা কাজল সরকারের মাথায় হাত।

এবার আবার ভাঁড় ফিরিয়ে আনতে গিয়ে পুজোর বাজেট পঞ্চাশ লক্ষ ছাড়িয়ে প্রায় পচাশি লক্ষে পৌঁছেছে। কিন্তু স্পনসররা আর জি কর কান্ড নিয়ে এতটাই ঘেঁটে আছেন যে কেউই এগিয়ে আসার সাহস দেখাচ্ছে না। কাজল আবার পুজো ফোরাম এর প্রেসিডেন্ট। জানালেন,– সব পুজোরই কমবেশি এই অবস্থা। আরজি করের নির্মম নারকীয় ঘটনার বিচার সবাই চায়। জাস্টিস সবার অন্তরের কামনা।

কিন্তু চিৎকৃত উল্লাসে তা প্রকাশ পেলেই কি তার সার্থকতা? ফ্ল্যাশবাকে উনিশশো নিরানব্বই এর উনিশে এপ্রিল দিল্লির মেহেরাউলির ট্যামারিন্ড রেস্তোরায় পৌঁছায়। সেখানে বিনা রামানির দেওয়া পার্টি চলছিল। বার টেন্ডার এর কাজে ছিল জেসিকা লাল ও সায়ন মুন্সী। হরিয়ানার কংগ্রেস নেতার পুত্র মনু শর্মা বার বন্ধ হওয়ার পরে জেসিকার কাছে মদ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর রেস্তোঁরার মধ্যেই গুলি চালিয়ে জেসিকাকে হত্যা করে।

মনু শর্মার শাস্তি চেয়ে সেই প্রথম ভারতে শোনা যায় জাস্টিস ফর জেসিকা ধ্বনি। সেবার এই চিৎকৃত উল্লাস ছিল না, ছিল নীরব প্রতিবাদ। মনু শর্মা শাস্তি পায়। এবারও শাস্তি হবে। কিন্তু তার জন্যে আর একটি হত্যাকান্ড! দুর্গাপুজোকে আমরা তো খুনই করছি!

Related Articles