
The Truth of Bengal, Mou Basu: “আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে….। ৫০তম বছরে বঙ্গ সমাজকে জোর ধাক্কা দিতে প্রস্তুত অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাব। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা “আমার দুর্গা কন্যা শ্লোক” কবিতার লাইন অবিকল উঠে এসেছে অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের মণ্ডপে। দেবী দুর্গার রূপ এখানে চিরাচরিত নয়। মণিপুরের জাতিদাঙ্গায় অত্যাচারের শিকার হওয়া নির্যাতিতা নারীদেরই এখানে দেবীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের পুজোয় মণিপুরের নির্যাতিতারা আর হিমালয়া কন্যা দেবী দুর্গা একাকার হয়ে গেছেন। অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের এহেন ‘হটকে’ থিম ও সামগ্রিক সৃজনের দায়িত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পী ভবতোষ সুতার।
কলকাতার থিম মেকিংয়ের জগতে নামি শিল্পী ভবতোষ সুতার ২০০০ সালে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর বড়িশার জনকল্যাণ সংঘের মণ্ডপ গড়ে তাক লাগিয়ে দেন। প্রত্যেক বছরই অনবদ্য সব থিম তুলে ধরে নজর কাড়েন এই শিল্পী। কিন্তু এবার পুরোদস্তুর পুজো শুরুর আগেই শিল্পী ভবতোষ সুতারের শিল্পকৃষ্টি ভাইরাল হয়ে গেছে। অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের এবছরের থিম ‘গণদেবতা’। মে মাস থেকে শুরু হয় মণিপুরের জাতিদাঙ্গা। কয়েক মাস আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় ভিডিও। তাতে মণিপুরে গণধর্ষণের শিকার হওয়া ২ মহিলা নগ্ন হয়ে সর্বসমক্ষে প্যারেড করতে বাধ্য হন। এরপর একাধিক বার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে আরো নানান সব মণিপুরের নারীদের ওপর নির্যাতনের নানান ভিডিও যা দেখে শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্বই। এবার অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের পুজো মণ্ডপে সাধারণ নারীর ওপর ঘটা বর্বরোচিত অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরবেন ভবতোষ সুতার। ভবতোষের উমা চিরাচরিত দেবী মূর্তি নয়। তাঁর সাজপোশাকে জাঁকজমক জৌলুস নেই। সাধারণ শাড়ি পরা মাটির প্রতিমার অবয়ব। দৃঢ়চেতা ভঙ্গিতে মিছিল করার আঙ্গিকে হেঁটে চলেছেন তিনি। ক্ষুব্ধ মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে যন্ত্রণা। চোখে নজরে পড়বে ক্ষোভের আগুন। জীবনের রণক্ষেত্রে অনবরত যুদ্ধ করে চলা সেই সাধারণ নারীর পেছনে হেঁটে চলেছে নানা বয়সের অসংখ্য নারী-পুরুষ। লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিকও হাঁটছে।
হঠাৎ এমন হটকে থিম বেছে নেওয়ার কারণ হিসাবে ভবতোষ সুতার জানান, “এরকম ঠাকুর গড়ার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিল না। কিন্তু মণিপুরের ঘটনা আমায় ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। মণিপুরের নারীদের ওপর যে অকথ্য অত্যাচার হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি একমাত্র ঠাকুর গড়ার মাধ্যমে আমার প্রতিবাদ করতে পারি। আমরা সুসজ্জিত মণ্ডপে ঠাকুর পুজো করি। নারী শক্তির আরাধনা করি আবার আমরাই নারীদের ওপর নির্যাতন করি, নিরন্তর অত্যাচার, অপমান করে চলি। গত বছর অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের পুজো মণ্ডপে ব্যালাড আর্টিস্টদের লাইভ সম্প্রচার দেখা গিয়েছিল। এবারও অন্য রকম পারফর্ম্যান্স থাকবে। আমার কাছে দুর্গাপুজো নিজেই পারফর্ম্যান্স। আমাদের মণ্ডপ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা দেবে। আবহে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা সাউন্ড সিস্টেমে বাজানো হবে।’
ছকভাঙা দেবী মূর্তির গায়ের টেক্সচার রুক্ষ। সাধারণ নারীর বিশেষ করে মণিপুরের নির্যাতিত নারীদের অত্যাচারকে বর্ণনা করতে দেবী মূর্তির গায়ে নির্যাতন, শারীরিক অত্যাচারের চিহ্ন থাকবে। আমরা যেভাবে দুর্গা মূর্তি দেখতে অভ্যস্ত তার চেয়ে একেবারে আলাদা অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের এবছরের দুর্গা। জাঁকজমকপূর্ণ দেবী প্রতিমাও নয় আবার গ্রাম্য মহিলাও নয়। পুজোর ক’টা দিন গণদেবতাকে চাক্ষুষ করা যাবে অর্জুনপুর আমরা সবাই ক্লাবের পুজো মণ্ডপে।
১৫ ফুট উঁচু দেবী মূর্তি। শিল্পী ভবতোষ সুতারের কথায়, “পুজো মণ্ডপে কোথাও মণিপুরের কোনো রেফারেন্স রাখিনি। কিন্তু দেবীর মুখায়বের সঙ্গে আদিবাসী মহিলার মুখের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। মহিলারাই সফট টার্গেট বলে সব সময় আক্রমণের শিকার হন। তাই আমার দুর্গা আসলে সব নারীই। দেবীর চেহারা পার্ফেক্ট মসৃণ নয়। অত্যাচারের চিহ্ন বর্তমান। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশও সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাঁটছে। দেবী এখানে প্রতিবাদীদের প্রতীক। ৮টা হাতের বাঁশের খুঁটির ওপর মাটির ইনস্টলেশন থাকবে যা দেবী দুর্গার বাকি আট হাতের প্রতীক। দেবী দুর্গার প্রতিবাদকে আরো বৃহত্তর আঙ্গিকে সংঘবদ্ধ করতে দর্শনার্থীরা চাইলে মাটি লেপতে পারবেন।’
Free Access