
The Truth of Bengal: থালার উপর কলাপাতা। তার উপরে চমৎকার চালের ভাত। পাশে লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা আর বাটিতে ডাল একপাশে ঝুরি ঝুরি আলু ভাজা আর মুড়িঘণ্ট। মটন কষা চাইলে বাটিতে ঝাল, ঝাল গরম মটনের ঝোল। আর মাছ চাইলে প্রমাণ সাইজের কাতলা থেকে পাবদা। রবিবার দুপুরে বাড়ির খাবার যদি মনে না ধরে, একটু অন্যরকম, আগেকার দিনের জমিদার বাড়ির মতো যদি পঞ্চব্যঞ্জনে উদরপূর্তির যদি ইচ্ছে থাকে, তাহলে ঘুরে আসতে পারেন স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল থেকে। কলেজ স্ট্রিটে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গা দিয়ে যে গলিটা চলে গেছে, যার পোশাকি নাম ভবানী দত্ত লেন, সেই রাস্তা দিয়ে একদম সোজা চলে গেলে যে বাড়িটায় ধাক্কা খাবেন, তারই নীচের তলায় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। কলকাতায় বাঙালি খাবারের যেসব ঠিকানা রয়েছে, সেইসব হাল ফ্যাশনের রেস্তোরাঁর সঙ্গে ভবানী দত্ত লেনের এই পাইস হোটেল যে সমানে পাল্লা দেয়, তার পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। পয়লা নম্বর কারণ অবশ্যই দারুণ রান্না, যেটা যে-কোনও ফুড আউটলেটকে সুপারহিট হতে সাহায্য করে। খারাপ গল্প হলে যেমন সারা আলি খান মিনি স্কার্টে নেচেও কুলি নম্বর ১-কে হিট করাতে পারেন না, তেমনই রান্না খারাপ হলে কোনও পাইস হোটেলও সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারত না।
তাই এটা বলাই বাহুল্য, স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের রান্না সবসময় অজিঙ্কা রাহানের ব্যাটিং-এর মতো। চোখ বুজে ভরসা করতে পারবেন। তার উপরে মাছের বৈচিত্র্য, ইলিশই বলুন কিংবা ডিম ভরা পার্শে, অথবা পাবদা… এই পাইস হোটেলের হেঁশেলে বিপজ্জনক ডেলিভারির অভাব নেই । ভোজনরসিকদের উইকেট তুলে নেবেই। এর উপরে হচ্ছে ঐতিহ্য। ক্রিকেটে যেমন লর্ডস বা এমসিজি, তেমনই কলকাতার পাইস হোটেলের দুনিয়ায় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের লম্বা ইতিহাস। দোকানে ঢুকলেই নজরে পড়বে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বিশাল ছবি, ক্যাশ এবং খরিদ্দারকে সামলাতে ব্যস্ত মালিকের সঙ্গে ভাব জমাতে পারলে জানতে পারবেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের এই পাইস হোটেলে খেতে আসার দুরন্ত সব কাহিনি। আসলে ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর, কলেজ স্ট্রিটে সময় কাটিয়েছেন এমন কোনও বাঙালি রাজনীতিকই বোধহয় স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলের দুপুরের মেনুর অমোঘ আকর্ষণকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
যেহেতু একদিকে কলেজ স্ট্রিট আবার অন্যদিকে হ্যারিসন রোড মানে মহাত্মা গান্ধী রোড দিয়ে এই পাইস হোটেলে পৌঁছে যাওয়া যায়, তাই কলকাতা শহরে কাজে এসে শিয়ালদহ বা হাওড়া দিয়ে ট্রেনে ফিরে যাবেন, এমন মানুষদের একটু তরিবৎ করে মধ্যাহ্নভোজনের জায়গা ছিল এই স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। সময় বদলেছে। এখন বোস্টন কিংবা ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতা পৌঁছেও অনেকে এই সাজসজ্জাহীন, কেঠো পাইস হোটেলে চলে আসেন ট্যাংরার ঝাল অথবা চিতল মাছ চাখতে। তার পিছনে কি শুধুই কলেজ স্ট্রিটের ফেলে আসা দিনগুলোকেও মনে করার টান বা নস্টালজিয়া, নাকি ভাল খাবারের দুর্নিবার আকর্ষণ? বোধহয় দুটোই। শতাব্দী পার করতে চলা এই পাইস হোটেল আজও বাঙালি রান্না, বিশেষ করে নিরামিষ বা মাছের পদের সেরা ঠিকানা। ঢুকে একবার দেওয়ালে টাঙানো বোর্ডে সেইদিনের মেনু বা স্পেশাল দেখে নিয়ে অর্ডার করে দিলেই নিশ্চিন্তি … এই জানুয়ারিতে, যখন নেতাজিকে স্মরণ করার জন্য সবাই ব্যগ্র, তখন সুভাষচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত এই পাইস হোটেলের রান্না চেখে আসাটা কিন্তু চমৎকার স্মৃতি তর্পণ হতে পারে!