রান্নাঘর

বাঙালি খাদ্যরসিকের কাছে কলকাতার চাউম্যান রেস্তোরাঁ

Chauman Restaurant

The Truth of Bengla: শরৎচন্দ্রের কোনও নায়ক কি ‘খাও সুয়ো খেয়েছিলেন? বর্মায় মানে আজকের দিনের মায়ানমারে যেসব বাঙালি গিয়েছিলেন তাঁরাই তো মুগ্ধ হয়ে এই নুডুলস স্যুপকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই ‘সিগনেচার ডিশ’ এখন গোটা পৃথিবীতে যে-কোনও ওরিয়েন্টাল রেস্তোরাঁর অন্যতম আকর্ষণ। খাস লন্ডনের চিনা রেস্তোরাঁতেও ‘খাও সুয়ে’-কে নিয়ে আগ্রহ মুখাইয়া মুরলীধরনের স্পিন বোঝার মতো করেই, কীভাবে বুঝে ফেলা যায়। এই প্রহেলিকাকে! ‘খাও সুয়ে’র মূল আকর্ষণ অবশ্যই নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না মাংস আর অসংখ্য অন্য উপকরণ, লেবু থেকে ধনে পাতা সবই যেখানে আলাদা আলাদা বাটিতে সাজানো থাকে। নুডুলসের সঙ্গে নারকেলের দুধে রান্না করা মাংস মিশিয়ে নিন, সঙ্গে থাকুক সেদ্ধ ডিমের কুচি আর নিজের রুচিমতো লেবু, লঙ্কা, ধনে পাতা মেশালেই নুডুলস স্যুপ তৈরি। কলকাতার চাউম্যান রেস্তোরাঁ এই ‘খাও সুয়ে’-কে বাঙালি খাদ্যরসিকের কাছে এমনভাবে নিয়ে এসেছে, যে মুরলীধরনের স্পিনের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণের মতো নিজেদের ডিফেন্সকে বিসর্জন দিয়ে এই পদকে না ভালবেসে উপায় নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজে চিনা রান্না চাখতে গেলে চিংড়ি বেশি পছন্দ করি। ব্যাঙ্গালোর প্রবাসী এক বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু চাউম্যানে খেতে গিয়ে বলল, “আমি রেস্তোরাঁয় মুরগি অর্ডার করি না, ওটা তো পাউরুটির মতো সবাই খায়, অন্য কিছু বলছি সেগুলো খেয়ে দেখো।” তার আগ্রহেই চাউম্যানের দুটি চিংড়ির পদকে চাখা, ‘প্রন সুইমুই’ এবং ‘প্রন কা সিয়ং’।

বুঝতে পারলাম ‘চাউম্যানের একাদশে শুধু মুরলীধরনের মতো বিপজ্জনক স্পিনার নেই, জয়সূর্য বা অর্জুনা রণতুঙ্গার মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানরাও আছেন, যেমন এই ‘প্রন সুইমুই’ এবং ‘প্রন কাসিয়া। চাউম্যানের ‘খাও সুয়ে’ যদি ডিফেন্স ধ্বসিয়ে দিতে পারে তাহলে চিংড়ির এই দুই পদ এতটাই বিধ্বংসী, স্কোরবোর্ডে কত রান উঠে গিয়েছে তা বুঝে উঠতে পারবেন না, মানে কটা আপনি খেয়ে ফেলেছেন। ‘সুইমুই’তে যেমন তেল-ঝাল একেবারে নেই, পরিবেশন করতেও হয়তো চাউম্যান মিনিট কুড়ি সময় নেয়, কিন্তু মুখে দিলেই গলে যাবে সেকেন্ডের মধ্যে আর ‘প্রন কা সিয়ং’ একেবারে গোটা চিংড়িটাকেই তেলে-ঝালে এমনভাবে রাঁধা যে টি-টোয়েন্টির মতো কখন প্লেট শেষ হয়ে গেছে খেয়াল থাকবে না। আগেই বলেছি চিনা খাবারের মধ্যে খেতে গেলে আমার চিংড়ি, মাছ বা কাঁকড়ার দিকেই বেশি ঝোঁক আর চাউম্যান প্রথাগত সব ওপেনারের পাশাপাশি নিজেদের মেনু চার্টে মাছ এবং চিংড়ির ‘পিঞ্চ হিটার’ অনেক পদ রেখেছে। ক্যান্টোনিজ চাউমিন কিংবা কুনফাও ফিশের মতো রুটিন পদের পাশাপাশি তাই চিংড়ি বা মাছের বিভিন্ন ধরনের পদ চাখার জন্য চাউম্যানের কোনও বিকল্প নেই। এখন যেহেতু ক্যালকাটা ক্লাবের মতো অভিজাত ঠিকানাতে চাউম্যান চিনা খাবারের পসরা নিয়ে হাজির তেমনই কলকাতা শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় চাউম্যানের আরও উনিশটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। একদা লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেবাদিতা চৌধুরি তাঁর চিনা খাবারের ব্র্যান্ডকে অবশ্য কলকাতা ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন ব্যাঙ্গালোর এবং দিল্লিতেও। তা ছাড়া সুইগি, জোম্যাটোর মতো ফুড অ্যাপ চাউম্যানের খাবার পৌঁছে দেয় ঘরে ঘরে, আর দেবাদিত্য নিজের উদ্যোগে নিজের ফুড অ্যাপ অর্থাৎ চাউম্যান অ্যাপ এবং নিজস্ব ‘ডেলিভারি মেকানিজম’ দাঁড় করিয়েছেন শহর জুড়ে। তাই বৃহত্তর কলকাতা জুড়ে কোথাওই আর চাউম্যানের চিনা খাবার পাওয়া কঠিন নয়।

চাউম্যানের যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। আর ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা ঋতুদা যেমন ডালহৌসী পাড়ার চিনা রেস্তোরাঁর সুলুকসন্ধান জানতেন তেমনই অতি দ্রুত চাউম্যানের খাবারের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। কত সন্ধ্যায় ঋতুদার ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে বসে যে চাউম্যানের গল্ফগ্রীনের আউটলেট থেকে আনা খাবার খেয়েছি তা বোধহয় শুনে শেষ করতে পারব না। ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ খুঁতখুঁতে এবং অন্দরসজ্জার দিকে যাঁর সদা নজর থাকত সেই অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক কলকাতার এই চিনা খাবারের ব্র্যান্ডের রেস্তোরাঁ ইন্টিরিয়রেরও সপ্রশংস ভক্ত ছিলেন। যেহেতু বিজ্ঞাপনের কপি লেখা নিয়ে। এই ‘মাভেরিক’ চলচ্চিত্র পরিচালকের পেশাদার জীবনের শুরু হয়েছিল তাই ঋতুদা মনে করতেন দেবাদিত্যর চাউম্যানের ক্যাচ লাইন হতে পারে, “দামে কম, মানে দারুণ!” এটা সত্যি ২০১০ থেকে বর্তমান সময়ে আসতে আসতে চাউম্যান যেমন আড়ে-বহরে বেড়েছে, গোটা ভারতবর্ষে তাঁর পঁচিশটারও বেশি আউটলেট, কিন্তু সে তাঁর প্রাথমিক পরিচয়টুকু হারিয়ে ফেলেনি, ‘দুর্দান্ত খাবার কিন্তু দাম আয়ত্ত্বের মধ্যে।’ সাপ থেকে স্টার্টার, মেই ফুন থেকে ডেজার্ট, চাউম্যানের সবকিছুকে দেবাদিত্য চৌধুরি তাঁর নিজের ‘প্যাশন’ এবং রুচি দিয়ে সাজিয়েছে এবং সেটাই হয়তো আজ চাউম্যানের সাফল্যের ‘ইউ এস পি’ বা ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’। সপ্তাহান্তে তো বটেই সপ্তাহের মাঝখানেও চাউম্যানে খেতে গিয়ে দেখলাম টেবিল পাওয়া মুশকিল, খাদ্য রসিকদের ভিড় লেগেই রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ফুড অ্যাপের ডেলিভারি বয়দের দৌড়োদৌড়ি। তবে কাউকে যদি ‘খাও সুয়ে’ চাখতেই হয় তাহলে বোধহয় সশরীরে চাউম্যানে ঢুঁ মারাই ভাল।

Related Articles