
The Truth of Bengal: একটা বাটিতে লোভনীয় একটা গ্রেভি। আর সেই গ্রেভিতে দেখা যাচ্ছে একটা আলু, একটা আস্ত পেঁয়াজ, একটা আস্ত টম্যাটো আর একটা ডিম। আর একটা মস্ত বড় মাংসের টুকরো। আমিনিয়া স্পেশাল। আমাদের ছোটবেলায় ধর্মতলায় আমিনিয়াতে খেতে গেলে এই ‘আমিনিয়া স্পেশাল’টা ছিল মাস্ট। গরম গরম নান রুটির সঙ্গে ‘আমিনিয়া স্পেশাল’ খাওয়ার মজাটাই ছিল আলাদা। তখনও পর্যন্ত ধর্মতলায় গেলে এলিট সিনেমায় সিনেমা দেখাটা বেশ একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল, আর এলিটের উলটোদিকে পুরসভার বিশাল লাল বাড়িটার বিপরীত ফুটপাথে আমিনিয়া ছিল সেরা আকর্ষণ। শৈশবের সেই দিনগুলিতে আমেনিয়া এবং তাকে অতিক্রম করে হগ সাহেবের মার্কেট, মানে নিউ মার্কেটই ছিল ‘জ্যাকপট’ আকর্ষণ। নিউ মার্কেটের ওপাশের যে সিনেমা হলগুলি সেগুলি তখনও ভীষণভাবে ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ একটা ব্যাপার, খবরের কাগজের স্টলে যে সব ম্যাগাজিন প্লাস্টিকে মুড়ে বিক্রি হত, সেই রকম একটা ব্যাপার আর কি। কিন্তু আমিনিয়া ছিল ভীষণভাবে বাঙালি মধ্যবিত্তের আয়ত্তের এবং সাধ্যের মধ্যে খাওয়ার জায়গা। মহিলারা সঙ্গে থাকলে পরদায় ঢাকা কেবিন মিলত, কিন্তু শুধু বাবার হাত ধরে ছেলে চলে গেলে আমিনিয়ার নীচের বড় হল ঘরটিই ছিল ভরসা।
বাবার কাছে গল্প শুনেছি, আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে যখন ধর্মতলায় আমিনিয়া রেস্তোরাঁ শুরু হয়েছিল, তখন তা শুধু খাওয়ার জায়গা ছিল না। পারিবারিক গল্প অনুযায়ী পূর্ববঙ্গ থেকে আসা আমার হিন্দু দাদু কলকাতায় বাসস্থান জোগাড়ের আগে ওই আমিনিয়ার মেসে বেশ কিছুদিন ছিলেন। ইতিহাসের কী আশ্চর্য সমাপতন দেখুন, আমার মুসলিম সহধর্মিণীর পারিবারিক গল্পও একই কথা বলে। তাঁর দাদুও পূর্ববঙ্গে নিজেদের সম্পত্তি বেচতে যাওয়ার জন্য যখন কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠতেন, তখন অনেক সময় এই আমিনিয়ার মেসেই রাত কাটিয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় একশো বছর ধরে বাঙালির কাছে আমিনিয়া একটা নির্ভরযোগ্য ‘ব্র্যান্ড’। স্বাধীনতার আগে যেটা ছিল থাকা এবং খাওয়ার জায়গা, আজকে সেটা হয়তো শুধুই রেস্তোরাঁ। এখন কলকাতা শহরে অবশ্য শুধু ধর্মতলাতেই আমিনিয়া নেই, তার আরও আটটি শাখা আছে। আর এই করোনা কালে যাবতীয় বিধিনিষেধের মধ্যেও সুইগি বা জোম্যাটোর মাধ্যমে আমিনিয়া থেকে খাবার আনিয়ে নিতে কোনও অসুবিধা নেই। বিশেষ করে এই ইদের সপ্তাহে আমিনিয়ার মটন বিরিয়ানি আর মটন পসিন্দা কাবাব, শেষ পাতের ফিরনি অথবা শাহি টুকরা সলমন খানের নতুন সিনেমার চাইতেও উত্তেজক হতে পারে। আমি অবশ্য সবসময়ই বলব, আমিনিয়া থেকে খাবার অর্ডার করতে হলে কোনওমতেই ‘আমিনিয়া স্পেশাল’-কে উপেক্ষা করা যাবে না।
আমিনিয়া স্পেশাল মানেই একটা নস্টালজিয়া, একটা অন্যরকম অনুভূতি। মোগলাই খাবারের রেস্তোরাঁ হিসাবে গত এক শতাব্দীতে কলকাতা শহরের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড ‘আইকনিক’ হয়ে উঠেছে। আমিনিয়া তার মধ্যে অন্যতম। এই সময়েও আমিনিয়ার বিরিয়ানির অর্ডারে কোনও কমতি নেই। আমিনিয়া অবশ্য অনেক ধরনের বিরিয়ানি বেচে, যেমন মটন বিরিয়ানিতেই একটা স্পেশাল ‘অবধি বিরিয়ানি’ পাওয়া যায়। এক হাঁড়ি অর্ডার করলে মোটামুটি দুজনের পেট ভরে যাবে। এই ‘অবধি বিরিয়ানি’তে মাংস থেকে আলু সবই ডাবল পরিমাণে থাকে। তার সঙ্গে যে-কোনও চাপ বা কাবাব আনিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমিনিয়ার যে-কোনও কাবাবের সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ সবুজ রঙের চাটনি, যা এত বছরেও চেহারায় এবং স্বাদে বদলায়নি। ইদ, অক্ষয় তৃতীয়া হয়ে ‘উইক এন্ড’ বা সপ্তাহান্তের যে লম্বা ছুটি, তাতে দুপুরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মনের মতো সিরিজ আর সঙ্গে আমিনিয়া থেকে অর্ডার করে আনানো খাবারের বিকল্প কী আছে? আসলেই তো তখন আমরা এই শহরের একটা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকা ঐতিহ্যকে আবার চেটে-পুটে নিয়ে বাইরের জীবনের বিবর্ণতাকে ভুলিয়ে দিতে পারি।