আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও
Destruction of evil forces and worship of truth and beauty are the mainstays of Shardotsava

Truth of Bengal, কাজল ব্যানার্জী: অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদোৎসবের মূল উপজীব্য। তাই, শারদীয়া হোক বা দীপাবলী, আসলে তা হল, বাৎসরিক অসূর নিধন উৎসব। অশুভ শক্তির বিনাস ও শুভশক্তির প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ফী বছর এই উৎসবের প্রথা। আর অশুভ অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুভশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের দিন হিসাবেই দুর্গাপুজোর দশমীর দিনটিকে বলা হয়ে থাকে ‘বিজয়া দশমী’।
অসুরকুলের দম্ভ-দৌরাত্ম্য থেকে দেবকুলকে রক্ষায় মাতৃরূপী ও শক্তিরূপী দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন। অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা দেবকুলকে রক্ষা করেন। অন্যায় ও অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করার মাধ্যমে এ ধরাধামে ন্যায় ও শুভবোধের প্রতিষ্ঠা ঘটে। দেবী দুর্গা শুভ, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামে মর্ত্যরে মানুষকেও সাহসী করে তোলেন। দূর করে দেন যত গ্লানি, হিংসা-দ্বেষ, মনের দৈন্য ও কলুষ।
আসলে সবটাই প্রতীকি। যেখানে অশুভ শক্তির ভূমিকায় অসূর ও শুভশক্তির ভূমিকায় মা দুর্গাকে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। কিন্তু কে এই অসূর, কেই বা দূর্গা? অশুভ শক্তি বা শুভশক্তির প্রকৃত অর্থই বা কী? মনোবিজ্ঞানের আলোয় বিশ্লেষণ করলে সহজে এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। অসততা, অপকর্ম, নিম্নমনোবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি, বেআইনী কাজে লিপ্ত হওয়া, হিংসা, অপরাধ প্রবনতা-ইত্যাদি বিষয়গুলি কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে আদিমকাল থেকেই জড়িত।
প্রত্যেক মানুষেরই অবচেতন মনে নানা অপকর্ম চরিতার্থ করার একটা সুপ্ত বাসনা থেকেই যায়। কারন, আমাদের মস্তিষ্কের অদস(Id) নামক স্তরটি আমাদের অবচেতন মন জুরে অবস্থান করে! নিজস্ব কামনা-বাসনা ও নিম্নরুচি চরিতার্থ করাই সর্বদা তার লক্ষ্য। কিন্তু, আমাদের মস্তিষ্কের ইগো(Ego) স্তরটি অনেক বাস্তববাদী। তাই অদসের(Id) সব ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়না। পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট বিচার করে ঝাড়াই-বাছাই(Filtering) করাই এই স্তরের কাজ।
মনের পরবর্তী স্তরটি অধিশাস্তা(Super-Ego)। যাকে বলা যেতে পারে বিবেক। যৌক্তিক বিশ্লেষন ছাড়াও নৈতিকতা-সহ বাকি বিষয়গুলিকেও বিবেচনা করে এই স্তর। তাই পৃথিবীর উন্নতত্তম জীব হিসাবে জীবনব্যপী আমাদের এই চাহিদা ও চাহিদার-নিবৃত্তির ভারসাম্য রক্ষা করার নামই জীবন। দুই সত্তার মধ্যে কতক্ষণ সময় কাকে কীভাবে ছেড়ে রাখববা আটকে রাখব তার ভারসাম্য রক্ষাই মানুষে-মানুষে পার্থক্য তৈরি করে।
আসলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই দু’টি পৃথক ও বিপরীত মুখী সত্ত্বা বা দ্বৈত সত্ত্বা বিরাজমান। একটি হল দৈত্য সত্ত্বা বা অশুভ সত্ত্বা এবং অপরটি হল দৈব্য সত্ত্বা বা শুভ সত্ত্বা। আমাদের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা দৈত্য সত্ত্বাটি হল কামনা, বাসনা, লালসা, ক্রোধ, হিংসা, হিংস্রতা-সহ সর্বপ্রকার রিপু ও ভোগের নেশায় পরিপূর্ণ। আর অপর দিকে দৈব্য সত্ত্বাটি সত্য, সুন্দর, শুভ্রতা, শৃঙ্খলা ও সততার পূজারী।
মানবিকতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা, মমতা ও উদারতায় পরিপূর্ণ এবং যৌক্তিক বোধে পুষ্ট। এই দুই বিপরীত সআমাদের মনোরাজ্যে সদা-সর্বদা পাশাপাশি স্বকীয় দাবিদাওয়া-সহ বিরাজমান। আদর্শ মানুষ হিসাবে আমাদের কাজ আমাদের নিজস্ব ওই দৈত্য সত্ত্বা বা অশুভ সত্ত্বাটিকে গারদের মধ্যে আটকে রাখা, যাতে সে নিজস্ব নিম্নরুচিগুলি চরিতার্থ করার কাজে সফলকাম না হতে পারে।
পাশাপাশি নিজস্ব শুভ সত্ত্বা বা দৈব্য সত্ত্বাটিকে যতটা বেশি সম্ভব সামনে আনা, যাতে আমাদের সুস্থ রুচি, সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গী ও সঠিক বিচারবোধের দ্বারা আমারা সামাজিক জীবনযাপনকে উন্নত করতে পারি। কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রথমোক্ত দৈত্যসত্ত্বাটিকে নির্বিচারে ছেড়ে রাখতে। ফলে সমাজজীবনে অবক্ষয়মূলক ছবি ফুটে ওঠে।
একজন মানুষের দৈত্যসত্ত্বার সঙ্গে অপরজনের দৈব্য সত্ত্বার লড়াই চলতে থাকে প্রতিমূহুর্তে। এখন এই লড়াইতে আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের দৈত্য সত্ত্বাটিকে নামিয়ে দিই তাহলে কিন্তু আমাদের বাসভূমি রক্তাত্ব হবে। আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। তাই ফী বছর শক্তির আরাধনার মূল লক্ষ্য হল, আমাদের নিজেদের মনেরই অসুর রক্তাত্বটিকে একটু সমঝে দেওয়া এবং দৈব্য সত্ত্বাটিকে উৎসাহিত করা।
তাই অসুর বধের প্রকৃত অর্থ হল, আমাদের নিজ মনের মধ্যে বসবাসকারী অসুর সত্ত্বাকে বিনাস করা।
এপ্রসঙ্গে পুরাণে যা কথিত আছে, তাও মনোবিজ্ঞানের এই তত্ত্বেরই সমার্থক। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার হত্যা করেন। প্রথমবার মা অষ্টভূজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভূজা দুর্গারূপে। মহিষাসুরের অনুরোধে মহিষাসুর দুর্গার উক্ত তিন ধরনের মূর্তির সঙ্গে পূজিত হয়ে থাকেন।
মূল কথা হল- শক্তির জন্য আমরা দুর্গাপুজো করে থাকি। জগতের কল্যাণ কামনায় মাকে হৃদয় মন্দিরে ধারণ করি। দুর্গা মূলত শক্তি দেবী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। যে সকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলো হল: মৎস্যপুরাণ মার্কেণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামেও পূজিতা হন।
বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে- আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপুজো। মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। মানুষের দেহ একটি দুর্গ বিশেষ। পঞ্চভূতে নির্মিত যথা- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুদ, ব্যোম। দেহের মূলশক্তি প্রাণশক্তিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য- এ ষড়রিপু আক্রমণ করে।
সাধকগণ সাধনাকালে মহাশক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার জন্য উদ্যোগী হয়। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাধে সংঘর্ষ। সেই অন্তর জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীক রূপ শ্রী শ্রী দুর্গার মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে।
এমনকি একই আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতেও অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশদিক রক্ষা করার প্রতীক। দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকাশক্তির প্রতীক অর্থাৎ সত্ব, রজঃ ও তমগুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী- একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, একটি সূর্যস্বরূপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা- তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ।
মহিষাসুর- দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এবং ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব- সর্বোপরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী- ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ- ধনশক্তির বা শুদ্রশক্তির, সরস্বতী- জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক।
শক্তিসমূহ অনুভূতির বিষয়। অনুভূতির আকার নেই। আকার দেওয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য। সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা। প্রকৃতপক্ষে, সর্বকালের সকল অশুভ ও আসুরিক শক্তি ধ্বংস করে সকল অত্যাচারীর হাত থেকে পরিত্রাণের মানসে শক্তি সঞ্চারের জন্যই আমাদের এই শারদোৎসব। তাই মা দুর্গার তথা শুভশক্তির এই বার্ষিক আরাধনা সমাজবিজ্ঞানের অনুসারী এবং মনোবিজ্ঞান নির্দেশিত যুক্তিনিষ্ঠ পথেই তার পথচলা। তাই শারদোৎসবের প্রকৃত উদ্দেশ্য তখনই স্বার্থক হবে যদি আমরা নিজ নিজ মনের অশুভ চাহিদা গুলিকে প্রতিহত করতে পারি।