কেমন করে ছানা কেটে মিষ্টি তৈরী করা হয় বিশ্বকে দেখিয়েছে বাঙালি
Bengalis have shown the world how sweets are made from chickpeas

Truth of Bengal, রাজু পারাল: দুর্গাপুজো ,কালীপুজোর পর বাঙালির ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আর এক উৎসব ‘ভাই ফোঁটা’। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই উৎসবের সিংহভাগ জুড়ে থাকে ‘মিষ্টি’। বাঙালির রসনা তৃপ্তি মিষ্টি ছাড়া পরিপূর্ণ হয় না। বলা যায়, বাঙালি আর মিষ্টি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। বাড়িতে অতিথি আগমন থেকে শুরু করে বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে মিষ্টির ভূমিকা যে অপরিহার্য তা বলাই বাহুল্য।
আর সেই মিষ্টির মধ্যে যদি থাকে ‘রসগোল্লা’ বা ‘সন্দেশ’ তাহলে তো কথাই নেই। জিভে জল এমনই আসবে। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা বিখ্যাত হয়ে আছে সেখানকার মিষ্টির পরিচয়ে। যেমন –শক্তিগড়ের ল্যাংচা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা ও সরপুরিয়া, বর্ধমানের মিহিদানা ও সীতাভোগ, জনাইয়ের মনোহরা, বিষ্ণুপুরের মতিচুরের লাড্ডু, বাঁকুড়ার মেচা সন্দেশ, মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া, নবদ্বীপের লাল দই, রানাঘাটের পানতুয়া ইত্যাদি।
বিদেশে দুর্গা পুজো অনুষ্ঠানের জন্য শুধুমাত্র বাংলার প্রতিমা যায় তাই নয়, বাংলার মিষ্টিও জাহাজে করে সেখানে পাড়ি দেয়। ভীম চন্দ্র নাগের মিষ্টি বিদেশে যায়। বিশেষ করে দুর্গাপুজোর সময়। সেখানে বিজয়া দশমী পালন করার সময়ে বা পুজোর চারটি দিন আয়োজন কালে বাংলার রসগোল্লা, সীতা- ভোগ দিয়ে দেবী মাকে ভোগ দেবার রীতি রয়েছে। কলকাতা বাগবাজারের সর্বজনীন দুর্গা পুজোতে রসগোল্লাকে মহাপ্রসাদ রূপে মাকে অন্নভোগের সময়ে দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য , পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এত রকমের মিষ্টি পাওয়া যায় তা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ আছে।
মিষ্টান্ন শিল্পের ইতিহাসে আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন ভোলা ময়রা, নবীন চন্দ্র দাস, ভীম চন্দ্র নাগ, কৃষ্ণ চন্দ্র দাস, নকুড় চন্দ্র নন্দী প্রমুখ এক একজন দিকপাল। ১৪০৬ বঙ্গাব্দে ভারতীয় উত্তরাধিকার লোকসংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকায় ‘ বাঙালীর মিষ্টান্ন’ প্রচ্ছদে ড. শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ” শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টির বিশ্বরূপ দেখেছিলেন কিনা জানি না; তবে বাঙালি বিশ্বকে দেখিয়েছে ছানা কেটে কেমন করে মিষ্টি তৈরী করতে হয়………মিষ্টি তৈরির ব্যাপারে বাঙালির এই বিদ্রোহ বিশ্বকে দিয়েছে রসগোল্লা সন্দেশ।” কথিত আছে, শ্রী চৈতন্যদেব মিষ্টি ভীষণ পছন্দ করতেন। তাঁর শিষ্য বা ভক্তরা দুধ বা দইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন গন্ধদ্রব্যের মিশ্রণে বিশেষ ভাবে তৈরী করতেন মিষ্টি।
এও শোনা যায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভীম নাগের সন্দেশ না খেয়ে রাতে শুতে যেতেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মীদের তিনি সন্দেশ খাওয়াতেন ভালোবেসে । তার জন্যে হাইকোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সময় ভীমনাগের দোকান থেকে ঝুড়ি ভর্তি করে নিতেন সন্দেশে। তাঁর সন্দেশ প্রীতি দেখে মুগ্ধ ভীমচন্দ্র নাগ ‘ আশুভোগ ‘ নামের একটি বিশেষ সন্দেশ বানিয়ে তার পেটেন্ট নিয়েছিলেন। যা মিষ্টান্ন শিল্পের ইতিহাসে বিস্ময়কর। বাড়িতে কোন অতিথি এলে আশুতোষ আগে সন্দেশ খাইয়ে তারপর তাঁদের কথা শুনতেন।
ভীম নাগের সন্দেশের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাথ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের মতো ব্যক্তিত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য লেডি ক্যানিং -এর জন্মদিনে ভীম নাগ বিশেষ যে মিষ্টিটি তৈরী করেছিলেন তা পরবর্তীকালে লেডি ক্যানিং এর নামানুসারে হয় ‘ লেডিকেনি ‘। রানি রাসমণীর বাড়িতে যে কোনও উৎসবে ভীম নাগের কড়া পাকের সন্দেশ ছিল একটি আবশ্যিক মিষ্টি। মিষ্টির প্রতি স্বামী বিবেকানন্দেরও ছিল ভীষণ দুর্বলতা। শোনা যায়, স্বামীজীর দক্ষিনেশ্বর গমনও নাকি মিষ্টি খাবার আশায়।
তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘ যদি আমাকে রসগোল্লা খাওয়াতে পারে তো ভাল, নইলে কান মলে দেব। একবার স্বামীজী দক্ষিনেশ্বরে অনেকদিন যাননি। ঠাকুর রামকৃষ্ণই স্বয়ং এলেন তাঁর কাছে । ঠাকুর বললেন, ‘ তুই এতদিন যাস নে কেন ? ‘ তারপর গামছায় বাঁধা সন্দেশ বের করে নরেনকে ‘ খা খা ‘ বলে খাওয়াতে লাগলেন। বলাবাহুল্য, ঠাকুরের সঙ্গে নরেনের সব সাক্ষাতেই মিষ্টিমুখ একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল।স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ রসগোল্লার স্বাদ গ্রহণ করে ব্রহ্মানন্দ অনুভব করেন এবং তৎ- ক্ষণাৎ সমাধি হয়েছিলেন শোনা যায়। বাঙালির মিষ্টি খাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে আসে সন্দেশ আর রসগোল্লার কথা।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে হুগলির ময়রা- -দের হাত ধরে ছানার তৈরী সন্দেশের আবির্ভাব হয়। একসময় কলকাতার নকুড়চন্দ্র নন্দীর সন্দেশ বিখ্যাত ছিল। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে উত্তর কলকাতার রামদুলাল স্ট্রিটে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই মিষ্টির দোকানের। সন্দেশ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা তাঁদের স্মরনীয় করে রেখেছে। বিশেষ করে শীতের সময় তাঁদের তৈরী নলেন গুড়ের সন্দেশ আজও সমান জনপ্রিয়।
সন্দেশের কথা বলতে গেলে জলভরা সন্দেশের প্রসঙ্গ আসবেই। সময়টা ১৮১৮ । দেশ তখন পরাধীন। ব্রিটিশ রাজত্ব। ঐ সময়ে হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বরের জমিদার বংশের নির্দেশে তৈরী হয় জলভরা সন্দেশের। হুগলির সূর্য মোদকের হাতেই সৃষ্টি হয় এই সন্দেশের। প্রায় দুশো বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও জলভরা সন্দেশ সমানভাবে সমাদৃত। তবে শুধু সন্দেশ নয়। মিষ্টান্ন শিল্পের ইতিহাসে রসগোল্লাও একটা বিশাল জায়গা জুড়ে আছে।
ইতিহাস বলে, মিষ্টির মধ্যে রসগোল্লার বয়স অনুমানিক ১৫০ বছর। বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাশ এবং ফুলিয়ার হারাধন ময়রার হাত ধরেই রসগোল্লার আবির্ভাব। একসময় নবীনচন্দ্রের রসগোল্লা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত বনেদি বাড়িগুলিতে কোনও অতিথি এলে তাঁকে আপ্যায়ন করা হত ‘রসগোল্লা’ দিয়ে। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িও এর থেকে বাদ ছিল না। রসগোল্লা নিয়ে বাংলা এবং ওড়িশার রনক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল একসময়। তাতে অবশ্য বাংলারই জয় হয়। রসগোল্লা নিয়ে বাংলার অনেক কবি কবিতাও লেখেন।