
Truth Of Bengal: ডঃ মনোরঞ্জন দাস: নাটক যেখানে জীবন ও জগতের ঘটনা প্রবাহগামী। নাটক হল, অতীত ও বর্তমানের চিত্রময়তার প্রতীক, কখনও ভবিষ্যতেরও ইঙ্গিত দেয়। নাটকে নাট্যকার মনন ও চিত্রনের অনুঘটক হয়ে কাজ করে। নাটক সম্পর্কে নজরুল জানতেন, নাটক হল লিখিত সংলাপের (গদ্য বা কবিতা) অভিনয়ের মাধ্যমে কাল্পনিক ও অ-কাল্পনিক ঘটনার চিত্রায়ণ…।
নাটক, সাহিত্যের একটি বিশেষ ধরন বা আধার। সাধারণত একটি লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে নাটক পরিবেশিত হয়ে থাকে। নজরুলের জীবনকাহিনিই হল একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। নাটকের সার্বিক উপাদান তার জীবন অধ্যায়ের অংশে অংশে পূর্ণ ছিল। জীবনের প্রথম দিকে তিনি অর্থকষ্ট লাঘবের জন্য জন্য লেটোর দলে যোগ দেন এবং সেই আঁধারে তিনি আত্মমগ্ন হন। আঞ্চলিক সংস্কৃতি সেখানে অধ্যায়বাহী হলেও তিনি সেখান থেকেই তিনি নাটকের রসদ খঁজে পান। পাঁচালি ও হালকা রসের মধ্য থেকেই তিনি বিশুদ্ধ নাটকের মৌলিকতা খুঁজে পেতেন।
নাটক উপস্থাপনার জন্য চাই সঠিক রঙ্গমঞ্চ। সেখানে প্রয়াসেরও একটা অধ্যায় থাকে। অথ: বলা চলে, ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ই বাংলায় প্রথম নাট্যমঞ্চ। মধ্যযুগকে মুসলমানদের সার্বিক পীঠস্থান ছিল। কিন্তু এ সময়ে মুসলমানরা নাট্যচর্চা শুরু করেনি। এ প্রসঙ্গে বলা চলে, ‘কাব্য-উপন্যাস- ছোটগল্পে বিশ্বসাহিত্যে প্রতিযোগিতায় স্পর্ধা অর্জন করলেও বাংলা সাহিত্যের নাট্য শাখাটি বিশেষ রূপে সমৃদ্ধ নয়। ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে আসার পর থেকে এই শাখাটির উদ্ভব ও বিকাশ। মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যেই যদি নাটকের সৃষ্টি হয় তা হলে নাট্যশালার সঙ্গে নাটকের যোগ প্রশ্নাতীত হয়ে পড়ে। কিন্তু রঙ্গমঞ্চ সৃষ্টির প্রারম্ভিক ইতিহাসে বাঙালির অবদান বড় করুণ। রঙ্গালয় সৃষ্টির প্রথম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত ওল্ড কোর্ট হাউসের নিকট একটি রঙ্গালয় এবং ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের হেরোসিম লেবেডফ্ প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ নামক রঙ্গালয়।
‘…মুসলিম অবদান ছাড়া মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কথা চিন্তা করা চলে না। এ যুগের বাংলা সাহিত্য মুসলিম লেখকদের প্রতিভায় ও অবদানে বিশেষরূপে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম লেখকদের এই দৈন্যদশার কারণ অন্বেষণ করলে দেখা যায় ইংরেজদের প্রতি নিদারুণ ক্ষোভে তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা বর্জন করেছিল, ফলে সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার নানান ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। তার উপর ছিল অভিনয় সংগীতচর্চা ইত্যাদির ওপর কঠোর শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ। ফলে নাটক লেখার কথা অনেকে চিন্তাই করতো না। এর ওপর তাদের কোনও নিজস্ব রঙ্গালয় ছিল না।’
সমসাময়িক সমায়ণ অধ্যায়ে নজরূল যে সব নাটক রচনা করেছিলেন, সেগুলি হল,’আলেয়া’, ‘ঝিলিমিলি’, ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘কালোয়াতী কসরৎ’, ‘ভূতের ভয়’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘শ্রীমন্ত’, ‘দেবীস্তুস্তি’, ‘মধুমালা’, ‘বিজয়া’। ‘হরপ্রিয়া’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘সেতুবন্ধ’, ‘শিল্পী’, ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’, ‘হকসাহেবের হাসির গল্প’, ‘মরা কাউয়া’, ‘একটি অসমাপ্ত পান্ডুলিপি’ প্রভৃতি।
প্রিয় সংস্পর্শ থেকে প্রিয়বোধের অণুরণন, যেখানে জীবন সংসর্গের প্রকরণ থাকে কর্মময়ে। কাজী নজরুল ইসলাম ঘটনাপ্রত্যয় ‘১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের পর একাঙ্কিকা বা রেকর্ড নাট্য রচনায় কবির প্রচেষ্টা লক্ষ্যণীয়। জীবনের এ পর্বের সৃষ্টিগুলি প্রধানত গ্রামোফোনের চাহিদা ও প্রয়োজনের তাগিদে রচিত। আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত এ ধরনের একাঙ্কিকা ও রেকর্ড নাট্যের তালিকাটি এই, ‘ছিনিমিনি খেলা’, ‘খুকী ও কাঠেড়ালী’, ‘জুজুবুড়ির ভয়’, ‘পন্ডিমশায়ের ব্যাঘ্র শিকার’, ‘পুরণো বলদ নতুন বৌ’, ‘বাঙালীর ঘরে হিন্দী গান’, ‘বিলাতী ঘোড়ার বাচ্চা’, ‘ঈদুল ফেতর’, ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘প্রীতি উপহার বা বিয়ে বাড়ী’, ‘কালোয়াতী কসর’, ‘শ্রীমন্ত’, ‘আল্লার রহম’, ‘কবির লড়াই’, ‘কলির কেষ্ট’, ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ’, ‘বনের বেদে’ প্রভৃতি।
কাজী নজরুল ইসলাম, তাঁর নিজস্ব ঘরানায় পুষ্ট ও আবর্তিত হয়ে নাটক রচনা করতেন। বিশেষত নজরুলের যুগটা ছিল স্বাধীনতা ও উত্তাল আন্দোলনের যুগ। কিন্তু তার রচিত নাটকগুলিতে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও পৌরাণিক প্রবাহ না থাকলেও মানুষের প্রেমময় রোমান্টিকতা, ব্যথা বেদনা, অনন্য ব্যঞ্জনা ও গীতিকাব্যের মধুয়তা বহন করেছেন। নজরুল তাঁর ‘আলেয়া’ নাটকে নর-নারীর প্রেম-তর্পণ কুহেলিকাময় অবদানে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নাটকে নান্দনিক নির্মাণে ও সংলাপাধারে তিনি বিশিষ্টতা এনেছেন। তিনি ‘মদালসা’র প্রেমোন্মত্ত গীতের মধ্য দিয়েই তা বুঝিয়েছেন,
‘কেন রঙীন নেশায় মোকে রাঙালে!
কেন সহজ ছন্দে যতি ভাঙালে।।
শীর্ণা তনুর মোর তটিনীতে কেন
অনিলে ফেনিল জল-উচ্ছ্বাস হেন,
পাতাল-তলের ক্ষুধা মাতাল এ যৌবন
মদির পরশে কেন জাগালে।।’
কাজী নজরুল ইসলাম ‘ঝিলিমিলি’ নাটককে রূপকের আধারে পরিবেশন করেছেন যেখানে আনন্দময় প্রেম, কঠোর বাস্তবতা, মনুষ্যলোক এবং স্বপ্নলোক একাকার হয়ে উঠেছে। বাস্তবতাকে বিস্তারের আখ্যানে একীভূত হলেও তা খুব বেশি বিশেষায়িত হয়নি। অনেকে ঝিলিমিলি নাটকে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের মিল দেখলেও তা সত্যই পরের দিকে মৌলিকতায় উন্নীত হয়েছে। এই নাটকে রসনা নিষ্পত্তিতে অপূর্ণতার মাত্রা সমাচ্ছন্ন। বস্তুত উন্নত শিল্পের লক্ষণ হল অপ্রাপ্তির মাঝে পূর্ণতা বা তৃপ্ত হওয়া। নজরুল এ নাটকে তা দেখিয়েছেন। ‘সেতুবন্ধ’ নাটকে নজরুল অনন্যতায় রূপকের সাংকেতিকতা এনেছেন। কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন তিনি এই নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকে তিনি যেন সম্পূর্ণতার এক প্রতীক।
এখানে তিনি দেব ও মনুষ্য শক্তির দ্বন্দ্বকে উপজীব্য করেছন। এই নাটকে তিনি উদার কাব্যবোধকে চেতনাবদ্ধ করেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির সাজুয্যে বস্তুময় অর্পণে থেকে সত্যোপলব্ধিতে একীভূত হয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ‘শিল্পী’ নাটকে রূপক আবহে আবর্তিত হয়ে বাস্তব ও রোমান্টিকতায় আসীন হয়েছেন। এখানে তিনি অপরূপ সুন্দরের সাজুয্যতা উজ্জীবিত হয়ে ধারাবাহী হয়েছেন যেখানে জীবনাদর্শ স্রোতবাহী। বলা চলে, ‘শিল্পতত্ত্ব সম্পর্কে নজরুলের চিন্তাভাবনা এবং জীবনাদর্শ এখানে সুন্দররূপে ধরা পড়েছে।
দুঃখবেদনা নিরপেক্ষ যে কোনও সৌন্দর্য বা শিল্পসৃষ্টি কোনদিন স্থায়ী হতে পারে না… যে শিল্পে আমাদের শাশ্বত বেদনাগুলি যত বেশী পরিমাণে বিধৃত হয় আমরা সেগুলিতে ততবেশী আকৃষ্ট হই, আনন্দ পাই। চিরন্তন শিল্পসৃষ্টির জন্য বেদপার পথ তাই অনিবার্য।’ ‘ভূতের ভয়’ নাটকে নজরুল রূপকের অংশে, ইতিহাসকে সম্পৃক্ত করেছেন। এই নাটকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট অঙ্কন করেছেন। বলা যায়, ‘একটু বক্তৃতাধর্মী হলেও নাটক হিসেবে ভূতর ভয় অনৈক বেশি সার্থক। কাহিনি, চিত্রচিত্রণ, গীতিধর্মিতা, সংগীত প্রয়োগ সকল দিক দিয়েই এ নাটকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তথাপি তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভূতের ভয় বহুল আলোচিত নয়।’
নজরুল ‘মধুবালা’ নাটকে মঞ্চসফলতা পান। এই নাটকে তিনি লৌককাহিনিকে ঋদ্ধ মালায় গাঁথলেও কাহিনি প্রসারে অমূলকতা বা চাতুর্য আনেননি। এই নাটকটি সংগীত বাহুল্যে সংবলিত। এই নাটকে সাঁইত্রিশটি গান আছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘সঙ্গীত মধুমালার এক বিশেষ সম্পদ। নাতিদীর্ঘ এই নাটকে গানের সংখ্যা সাঁইত্রিশ। সুরের অভিনবত্বেও সেগুলি অনন্য। নজরুলের অন্যান্য নাটক এবং একাঙ্কিকা নাটকগুলিতে জীবনদর্শন, সমসাময়িকতা, অনাবিল আবেগ নির্ভরতা, চেতনা বিন্যাস, মানবিক গুণ অপগুণের আধার, সুস্পষ্টতার বিন্যা বিদ্যমান।
একটি কবিতা দিয়ে শেষ করি,
‘একক অনন্যতায় তুমি ঋদ্ধ, অনাবিল,
হে নজরুল,
উপযোগী অধ্যায়ে তোমার নাট্যাধারা
সত্যে সাবলীল। তুমি নির্মাণের তীর্থে যেন এক সমাবেশ,
সারার্পণে এক সমৃদ্ধ আবেশ।