কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ির পত্তন হয় অযোধ্যারাম রায় এর হাতে ধরে
Kasimbazar small palace was built by Ayodhya Ram Roy

Truth Of Bengal: কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ীর পত্তন শুরু হয় অযোধ্যারাম রায় এর হাতে ধরে। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থাপত্য গড়ে উঠে এই রাজবাড়ীর বংশধরদের পৃষ্ঠপোষকতায়। কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ীর সামান্য উত্তরে অবস্থিত দশ শিব মন্দির তেমনই এক স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তৎকালীন গঙ্গা বা বর্তমান কাটি গঙ্গার পাশেই মন্দিরগুলি নির্মিত হয়েছিল বিভিন্ন সময় এই রাজবাড়ীর বিভিন্ন বংশধরদের দ্বারা। তবে অনেকে মনে করেন ধর্মপরায়ণা রাণী আর্নাকালী দেবীই এই দশ শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও এই বিষয়ে কোনও সঠিক আলোকপাত করতে পারেন নি রায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা।
অতীতে তিন দিকে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল এই মন্দির গুচ্ছ, যে প্রাচীরের আজকে কোনো অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এই দশ শিব বাড়ির প্রশস্ত অঙ্গনে প্রবেশ করার জন্য পশ্চিমদিকের প্রাচীরে একটি প্রবেশদ্বার আছে। প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেই বামদিকে অর্থাৎ উত্তরদিকে প্রাচীরের গা ছোঁয়া পূর্ব মুখি ২টি শিব মন্দির চোখে পড়ে। আর ডান দিকে রয়েছে আরও ৩টি মন্দির। এবং সামনের দিকে রয়েছে বাদবাকি পাঁচটি শিব মন্দির। প্রতিটা মন্দিরেই রয়েছে একটি করে শিবলিঙ্গ। শোনা যায় শিবের দশরূপের প্রমাণ দেয় এই দশ শিবলিঙ্গ।
এমনকি শিবের দশনাম ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিটা মন্দিরের নামকরণেও এমনটা জানালেন এই রাজবাড়ির বংশধর পল্লব রায়। একদম প্রথম মন্দিরের ইষ্ট দেবতার নাম ভৈরব নাথ। পূর্ব মুখি উত্তর – দক্ষিণে বিস্তৃত উত্তর দিক থেকে দ্বিতীয় মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম বিশ্বনাথ। যথাক্রমে পূর্ব মুখি তৃতীয় মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম বৈদ্যনাথ। পূর্বমুখি চতুর্থ মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম সোমনাথ। পূর্বমুখি পঞ্চম মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম রামেশ্বর নাথ। এছাড়া অঙ্গনের দক্ষিণ দিকে প্রাচীরের প্রায় গা ছোঁয়া পাশাপাশি উত্তর মুখি আরও পাঁচটি মন্দির আছে।
এই পাঁচটি মন্দিরের মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে উত্তরমুখি প্রথম মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম তারকনাথ। যথাক্রমে উত্তর মুখি দ্বিতীয় মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম ত্রম্বকনাথ।পরবর্তী অর্থাৎ তৃতীয় উত্তরমুখি মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম অমর নাথ। চতুর্থ উত্তর মুখি মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম কেদারনাথ। এই সারির শেষ অর্থাৎ পঞ্চম উত্তর মুখি মন্দিরের ইষ্টদেবতার নাম সারনাথ। এই মন্দির গুলি সমষ্টিগত ভাবে ইংরেজি এলফাবেট এল-অক্ষরের সৃষ্টি করেছে। তবে শোনা যায়, কোন কারণে শেষ মন্দিরের শিবলিঙ্গ উধাও হয়ে যায়, তখন কাশী থেকে শ্বেত বা সাদা শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয় বলে জানালেন এই অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা অসীম কুমার রায় জমিদারি আমলের সময় এই মন্দিরগুলো ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ।
চারদিকে উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত এই মন্দিরগুলিতে দুবেলা পুজো হত ঘটা করে। তখন প্রতিদিন পাঁচ পোয়া আতপ চালের অন্নভোগ হত। তার সঙ্গে থাকত দশটি কাঁচা মিষ্টি এবং দশটি পাকা কলা। কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে সন্ধ্যায় হতো সন্ধ্যারতি। সেকালে দেবতার উদ্দেশ্যে যে ভোগ হতো তাকে বলা হতো দান।শিবরাত্রির সময় স্থানীয় মানুষজন ভিড় জমাতো এই মন্দির চত্বরে। বসতো মেলাও। বর্তমানে সেইসব দিন আর নেই, মন্দিরগুলি অবহেলায় পড়ে থেকে থেকে জরাজীর্ণ অবস্থায় প্রায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেঙে পড়েছে মন্দিরের দেওয়ালগুলিও। খসে পড়েছে পলেস্তরা। মন্দির চত্বরের বিভিন্ন অংশে গজিয়ে উঠেছে আগাছার জঙ্গল। মন্দির প্রাঙ্গনও পড়ে আছে অবিচ্ছন্ন অবস্থায়।
অতীতের গৌরবের প্রতি অবহেলা সত্যিই বেদনাদায়ক। এই অবহেলার ফলে সনাতনী হিন্দুধর্মের ইতিহাসের অনেক অনন্য নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। কাশিমবাজারের এই ইতিহাস বিজারিত এই দশ শিব মন্দিরের ঐতিহ্য আগের মত না থাকলেও প্রতিবছর শিবরাত্রির সময় এখানকার স্থানীয় মানুষজন মহাধুমধামে এখনও শিব রাত্রির উৎসব পালন করেন। এবং চৈত্র সংক্রান্তির দিনগুলোতে এখানে খুব ঘটা করে চড়ক উৎসব বা গাজনের মেলা পালন করা হয়। এর ফলে, বয়সের ভারে ক্ষয়িষ্ণু হলেও কাশিমবাজারের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য গুলির মধ্যে এই দশ শিব মন্দির অন্যতম যা সময়ের সাথে যুদ্ধে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
অষ্টাদশ শতকের অবিভক্ত বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই মুর্শিদাবাদের মাটিতেই গঙ্গা নদীর একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি নদীর সৃষ্টি হয়, যার নাম কাটিগঙ্গা। এই বাঁকের অংশে এক অখ্যাত নদী বন্দরের পথ চলা শুরু হয়েছিল। সেই নদী-বন্দরের নাম হল কাশিমবাজার। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে মুর্শিদাবাদে চলে আসে। তখন বাণিজ্য নগরী হিসেবে কাশিমবাজারের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
অল্পদিনেই নিজ যোগ্যতায় সে ধারণ করে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা। সেই কাশিমবাজার বন্দর পরবর্তীতে প্রায় ২০০ বছর ধরে বিশ্বের দরবারে নিজের গৌরবগাঁথা অর্জন করে। ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বণিকগণ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে তখন পাড়ি জমান এই কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে। একে একে এখানে এসে উপস্থিত হন আর্মেনিয়ান, ডাচ, ফরাসি ও ব্রিটিশদের মতন বিদেশী বণিকেরা। আস্তে আস্তে অসংখ্য দেশীয় বণিকদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে এই কাশিমবাজার। বাণিজ্যনগরীর সেই সোনার দিনগুলি আজ আর নেই। কেবলমাত্র কিছু স্মৃতি সৌধ বা স্থাপত্য সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। যার অন্যতম স্থাপত্য হল আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে নির্মিত এই দশ শিব মন্দিরটি। যা বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের কাছে আজও অপরিচিত হয়েই আছে।