কালীগঞ্জ সংলগ্ন গঙ্গা তীরে রাজরাজেশ্বরীকে স্বপ্নে দেখা পান
He saw Rajarajeshwari in a dream on the banks of the Ganges near Kaliganj

Truth Of Bengal: দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়: রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার সপরিবারে কাশী বেড়াতে যান। সেখানে অন্নপূর্ণা মন্দির আর তাঁর পুজো তাঁকে মুগ্ধ করে। এর বেশ কিছু কাল পরে তাঁর মাতা কাশী যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। রাজা সেই মতো আয়োজনও করেছেন। বাদ সাধলো মায়ের শরীর। কী করবেন ভাবছেন, রাতে ঘুম হল না। সকালে রাজমাতা বললেন মাতা অন্নপূর্ণা তাঁকে স্বপ্নে বলেছেন যে কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কালীগঞ্জ সংলগ্ন গঙ্গা নদীর তীরে তিনি মাতা রাজরাজেরশ্বরী রূপে অবস্থান করছেন। সেখানে কাশী অন্নপূর্ণা মন্দিরের পুজোর রীতি মেনে মাঘ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে তিনি পুজো চান। রাজা সন্ধান করতে শুরু করলেন ভাগীরথীর তীরে কালীগঞ্জ নামক স্থানের।
নায়েবের কাছে শুনলেন ব্রিটিশ নির্মিত সুখসাগর জনপদ যার জন্ম হয়েছিল ১৭৬০ সালের পরে কিন্তু অষ্টদশ শতাব্দীর শেষ দিকে গঙ্গা বক্ষে বিলীন হওয়ার পর সেখানকার বাসিন্দারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। বিখ্যাত কালীবাবু মাত্র এক শত কুড়ি টাকায় গঙ্গার তীরে একটি মাঠ কিনে সোম-শুক্র হাট এর পত্তন করেন। পরে তা গঞ্জে পরিণত হয় নাম হয় কালীগঞ্জ বাজার। তখন ভাগীরথী গঙ্গা এই অঞ্চলে প্রবল, বিরহীর মদনগোপাল এই গঞ্জ দিয়েই কৃষ্ণনগর যাতায়াত করে। ক্রমে দারুন এক জনপদ-এ পরিণত হল এই স্থান। আনুমানিক ১৭৭৬ সাল নাগাদ এই পূজো শুরু হয়। পরবর্তী কালে রাজা নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন।
মহাপ্রভু শ্রী শ্রী চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পরে এই পথে যশরা জগন্নাথ মন্দির, দ্বাদশ গোপাল মহেশ পন্ডিতের বাটি পালপাড়া হয়ে চাপাল গোপালকে উদ্ধার করতে যান সেই অর্থে শ্রী শ্রীমন্মহাপ্রভূর পদরজ মিশ্রিত পুন্যভূমি আজ ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি।
এখন প্রয়াগে মহাকুম্ভ স্নান সহ মেলা চলছে। মাঘীপূর্ণিমা তিথিতে গঙ্গা স্নান করে সাধ্যমত দান করে মাতা রাজরাজেরশ্বরী পুজো ও আরাধনাতেও মহাকুম্ভ স্নানের পুন্য অর্জন হয়। এই পুজো উপলক্ষে সেই সময় একমাস যাবৎ কাল ধরে মেলা চলত, অনুষ্ঠিত হত নানা সাস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক অভিনয়, যাত্রা অভিনয়, রামযাত্রা, কবিগান, রামায়ণ গান, প্রভৃতি। সেই থেকে আজও চলছে।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইছামতি উপন্যাস অনুযায়ী মাঘী পূর্ণিমার মেলায় দূর দূরান্ত থেকে গরুর গাড়িতে আগত পুণ্যার্থীরা মন্দির এর পাশে বিরাট আমবাগানে তাঁবু গাঁড়ত, সেখানে হত রান্না বান্নার আয়োজন। বয়স্ক মানুষের কথায় ছোট বেলায় গরুর গাড়িতে যেতাম মেলায়। সেখানে গঙ্গা থেকে জেলেদের কাছ থেকে সদ্য ধরা ইলিশ মাছ কিনে বনভোজন করতাম। বিকেলে মেলা দেখে কোন আত্মীয় বাড়ি থেকে যেতাম। পরের দিন বাড়িতে ফিরতাম। ভাগীরথী গঙ্গা ধীরে ধীরে সরে গেল, সরকারদের আমবাগান বিক্রি হয়ে সেখানে বসতি গড়ে উঠল। মেলার জায়গা কমে গেল। এমন কী মন্দিরের দেবত্ত্বর সম্পত্তিও আজ বেদখল। উদ্যোক্তারা উৎসাহ হারাল।
এই ভাবে ক্রমে মেলার জৌলুস হারালো। তা সত্ত্বেও আজও মাঘী পূর্ণিমার ভোরে অগণিত পুণ্যার্থী গঙ্গা পুকুরে স্নান সেরে ভিখারি বিদায় দিয়ে শ্রী শ্রী রাজরাজেরশ্বরী মাতার পুজো করেন।মেলায় ভিড় জমে ব্যাপক। মাতৃরূপ টি এমন যে আধো নিদ্রায় শায়িত মহাদেবের নাভিপদ্ম থেকে মহাশক্তি রাজরাজেশ্বরী উত্থিত হয়েছেন। যাঁর বামে গঙ্গা, দক্ষিণে যমুনা, একচালা ঠাকুর নিচের অংশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও ইন্দ্রের মূর্তি। আলাদা করে ব্রহ্মা পুজোও করা হয়।
লোকমুখে শোনা, কোনো এক বছর ভয়ঙ্কর আগুনে বহু মানুষের সম্পদ পুড়িয়ে ছাই করে খুব ক্ষতি হয়। সেই থেকে ব্রহ্মাও পূজিত হন একই সাথে। দুই একজন বাদ দিলে এবছর বাজার কমিটি ও মেলা কমিটির সদস্য প্রায় একই, বাজারের দোকানদার, স্থানীয় মানুষ জন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যে অনুদান দেন তাঁর উদবৃত্ত অংশ দিয়ে মন্দির উন্নয়ন হয়। এত পুরোনো ঐতিহ্য পূর্ণ একটা মন্দির সরকার উদ্যাগ নিলে আরও ভালো হয়, বলছেন স্থানীয় মানুষজন।
শিক্ষক স্বপন আচার্য বলেন, এখানে প্রচুর মানুষ প্রসাদ গ্রহণ করবেন। রাজরাজেশ্বরী পুজো উপলক্ষে জায়গা না থাকার কারণে আমার বাড়িতেই রান্না থেকে আরম্ভ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করি।
এই দিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। আগে যেমন রান্না করে খাওয়ানো হতো মানে খেতে হত এখন আমরাই কিন্তু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করি। বিপুল সরকার এলাকার বাসিন্দা। তিনি জানান যে এই উপলক্ষে আমাদের প্রচন্ড খাটাখাটনি চলে। বাবাদের মুখে শুনেছি, আগে যে রকম ভাবে পুজো হতো এখনও হয়। তবে নাটক যাত্রা এসব আর হয় না। রাম হালদার বলেন, আমরা কিছু নয়। কিন্তু মায়ের ইচ্ছাতেই আপন ভাবে এটা হয়ে যাচ্ছ। মা-ই সবকিছু জোগাড় করে নেয়। আমরা শুধু নিমিত্ত মাত্র।