রাজ্যের খবর

ফিউশন মিষ্টির ভিড়েও বাংলায় এগিয়ে আজও ট্র্যাডিশনাল মিষ্টি

Bengal is in a rush for fusion sweets, but traditional sweets are still ahead

Truth Of Bengal: মধুবন চক্রবর্তী: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলেছে মিষ্টিরও। ট্র্যাডিশনালের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে নতুন স্বাদ। যদিও লড়াইয়ে ট্র্যাডিশন কিন্তু আজও এগিয়ে। যদি গানের কথা বলেন, সেখানেও বলবো স্বর্ণযুগের গান বা পুরনো দিনের গান বা পুরনো সময়ের গান আজও মানুষ একই রকম ভাবে শুনতে পছন্দ করেন, নতুনকে বরণ করে নিযেও।

গানের ভাষা বদলে গেলেও গানের চরিত্র সমাজ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বদলে গেলেও, স্বর্ণযুগের গান আজ ততটাই আধুনিক। সেরকমমভাবে মিষ্টির চরিত্র বদলে গেলেও, সনাতনী মিষ্টি আজও আমাদের কাছে স্বর্ণযুগের গানের মতই। হ্যাঁ এটা ঠিক, চিরন্তন এই লড়াই চিরকালই চলবে l তবুও বিজয়ার মিষ্টি মুখে বাঙালির অরুচি নেই। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সিল্ক ক্রাউন স্ট্রবেরি কুম্ভ মোগলাই অ্যাফেয়ার, চকলেট মালাই এবং রোলের মতন মিষ্টি। শুধু এগুলো কেন? রয়েছে আরোও অনেক কিছু। দশমীর সকাল থেকে যেরকম ভিড় সামলানো দায়, সেরকম শীতের আমেজে মিষ্টির মিষ্টির চাহিদা দোকানগুলিতে।

সরপুরিয়া, কাঁচাগোল্লা, জলভরার মত ট্রাডিশনাল মিষ্টির পাশাপাশি বাজার মাতাচ্ছে বাটার স্কচ, পাইন আপেল, চকলেট সন্দেশের মতো ফিউশন মিষ্টি। বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ঘুরে একটা ব্যাপার দেখেছি, সবকিছুকেই টেক্কা দিচ্ছে আজও, এই একুশ শতকেও ঐতিহ্যের টান। বাঙালি সনাতন রসগোল্লা, সন্দেশের বাজার এখনোও অপ্রতিরোধ্য। যদিও ট্রাডিশনাল মিষ্টির সঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট কিন্তু ভালোই চলছে। যতই এক্সপেরিমেন্ট হোক, আর ফিউশন মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি হোক না কেন, ঐতিহ্যপূর্ণ সন্দেশের কদর বছরের পর বছর ধরে চলে এসেছে। যেরকম জলভরা থেকে করিগজা, মিহিদানা থেকে সিতাভোগ। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে জানেন। পুজোর আগে থেকেই বাড়িতে তৈরি হত নাড়ু। বাড়ির সকল মহিলারা পিসিমা কাকিমা, ঠাকুমা, আবার মাসি, মাসির ননদ, পাশের বাড়ির কাকি, সবাই একত্রিত হয়ে নাড়ু বানানো নিয়ে জল্পনা কল্পনা করতেন।

আর সেই মতো বানানো হতো নাড়ু, নারকেল নাড়ু। নারকেলের বরফি, নারকোলের তক্তি, আর আরোও একটা মিষ্টি কথা মনে পড়ে সেটা হল বালুসাই। এসব বলতে গেলে তো ইতিহাস। তখন নেহাতই ছোট। তবু সেই জমজমাট মিষ্টির আসর। হাসি, ঠাট্টা, গল্প, মজা আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেত। সেই সঙ্গে নাড়ুর গন্ধ। আর সেটাই ছিল বিজয়ার প্রাকমুহুর্ত। আর বিজয়া আসলে তো কথাই নেই। হয়ে উঠত নারকেলময় বিজয়া। নারকেলের নাড়ু, নারকেলের তক্তি, এটাই ছিল আমাদের বাড়ির সবথেকে প্রিয় মিষ্টি। তবে বিজয়ার খাবার বলতে প্রথমেই মনে আসে দশমির সকালে দই কড়মা।

কথাটা আসলে দধি করম্ভ অর্থাৎ দই মিশ্রিত ভোগ। বৈদিক নিয়ম অনুযায়ী বিসর্জনের দিন দই মেখে দেবতাকে নিবেদন করা হয়। দই খই এর পরিবর্তে ক্রমে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মুড়কি, কলা। বনেদী বাড়িতে আরোও কত কি সব যে মেশানো হয়। পুজোর আমেজ চলে গেছে অনেকদিন আগেই। তবে মিষ্টির আমেজ বিজয়ার আমেজকেও ছাড়িয়ে যায়। দই কর্মা হয়তো শীতকালে আপনার ভালো লাগবে না। তবে নারকেলের তৈরি মিষ্টি যেকোনো ঋতুতেই আপনার ভালো লাগবে।

বিশেষ বিশেষ কোন উৎসবে বিশেষ করে বিজয়ের উৎসবে মিষ্টি খাওয়ার আনন্দটাই আলাদা এটা ঠিক। তবে এই আনন্দের রেশ আজ অনেকটাই বিলুপ্ত। মিষ্টি মুখের আনন্দে একসময় গা ভাসিয়ে চলতাম আমরা। সেই সময় দশমী এসে যাওয়া মনে মিষ্টির প্রতি হ্যাংলামিটাও বেড়ে যাওয়া। দশমী আসলেই, মৃত্তিকার বাড়ির মালপোয়ার কথা মনে পড়ে যেত। মিষ্টি পাওয়া যেত বড়দের প্রণাম করলেই। তাই আমি, অদিতি, সুকন্যা, বানজারা, সুতপা, গুগুল বিজয়ার ঠিক পরের দিনই হাজির হয়ে যেতাম মৃত্তিকার বাড়ি। আমি জানতাম এই দিনে বা এই দিন থেকেই মৃত্তিকার বাড়িতে মিষ্টিমুখের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

গরম গরম মালপোয়া চলে আসতো প্লেটে করে। মালপোয়া খেতে খেতে আমরা সকলেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত সংলাপের কথা আওড়াতাম ‘মাসিমা মালপোয়া খামু”….. যে কোন ঋতুতেই ভরসা , না এটা কোন মিষ্টি স্বাদ নয়, নোনতা স্বাদের খাবার। সেটা হল নিমকি। নিমকিতে আমার মা ছিলেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। দেখতাম ঘিয়ের ময়ান দেওয়া ময়দা খুব ভালো করে নুন, কালো জিরে, তেল দিয়ে মেখে প্রথমে লুচির মতন করে বেলে নিতেন। মা বলতেন নিমকি তৈরির আসল কেরামতি নাকি বেলাতে। দেখতে হয় বেলার সময় পরতগুলো জড়িয়ে না যায়। ভাজার আগে কাঁচা অবস্থায় নিমকির গায়ে কয়েকটা ছিদ্র করতে হয়। এর ফলে ভাজার সময় নিমকিগুলো কখনোও ফুলে উঠবে না।

ঠাকুমা বলতেন নিমকি ভাজতে হয় ভাসা ঘিয়ে মন্দ আঁচে। বাড়িতে মনে আছে পদ্মপাতা, তেকোনো আর কুচো এই তিন ধরনের নিমকি হতো। নিমকি ভাজার গন্ধে ম ম করতো গোটা পাড়া। বিশেষ করে খাঁজকাটা, পদ্মপাতার নিমকি দারুন লাগতো আমার খেতে। তাই পদ্মপাতার নিমকি বানানোর সময় মন দিয়ে দেখতাম। তবে যাই বলুন, আমাদের পুরনো শহর কলকাতা শুধু নয়, গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে মহিলারা দু-তিন দিন আগে থেকেই বাড়িতে নানান স্বাদের মিষ্টি আর স্বাদ পাল্টানোর জন্য সামান্য নোনতা তৈরির আয়োজন শুরু করে দিতেন। আর একটা সময় তো ছিল একান্নবর্তী পরিবার। তখনকার মিষ্টির চাহিদাটাই ছিল আলাদা।

এখন যেরকম পেটে খিদে মুখে লাজ। বা বলতে পারেন জীবনযাত্রার বদলের কারণে মধুমেহ রোগে জর্জরিত বাঙালির বিজয়ার মিষ্টিমুখ করা হয় না ঠিকই, তবু মিষ্টির প্রতি চিরকালীন সেই হ্যাংলাপনাটা আজও রয়ে গেছে। খেতে না পারলে কি হবে চোখের দেখা তো আছে। তাই আজও বিজয়া আসলেই মিষ্টি গন্ধে ভরে ওঠে বাঙালির হৃদয়। যদিও অন্য বাড়িতে বিজয়া করতে গেলে কেউ আর মিষ্টি খেতে চায় না। যেটা বলছিলাম রক্তের শর্করা বৃদ্ধি সংক্রান্ত উৎকণ্ঠিত আশঙ্কায় মিষ্টিকে ব্রাত্য করে দিতে চাইলেও, পুরোপুরি সম্ভব নয়।

তাই শৈশবের স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে মনে পড়ে গেল সেই নারকোলের তক্তির কথা। মার হাতে তৈরি এই নারকেলের তক্তির স্বাদ যেন অলৌকিক স্বাদ। ঘরেতে বসেই নারকেলের তক্তি নিজেও বানিয়ে ফেলতে পারেন। অবসরে তো আমরা অনেক কিছুই করি, একটু নয় মিষ্টিই বানালেন। এই শীতেও বানিয়ে ফেলতে পারেন সুস্বাদু তক্তি। বানাতে কি কি নেবেন – দুটো নারকেল করানো। তিন প্যাকেট ছোট দানার মিছড়ি। অন্ততপক্ষে চিনি লাগবে আড়াইশো গ্রাম। এক লিটার থেকে দেড় লিটার দুধ। এলাচ দানা, কিসমিস, পরিমাণ মত ঘি।

কিভাবে বানাতে হবে নারকোলের তক্তি দুধের পরিমাণ এক লিটার থেকে দেড় লিটার আগেই বলেছিলাম। তবে নারকেল যতটা থাকবে তার তুলনায় বেশি পরিমাণ দুধ নিতে হবে। দুধ ফুটবে আর তার মধ্যে নারকেলের গোড়া দিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ ফুটন্ত দুধের মধ্যে নারকেল দিতে হবে তারপর হাতা দিয়ে ভালো করে নাড়তে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত দুধ আর নারকেলের গন্ধ মিশ্রিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নেড়ে যেতে হবে দুধ। এরপর আন্দাজমতো মিছিরি এবং চিনি দুটোই মেশাতে হবে। তারপর আবারোও পাক দিতে হবে। অর্থাৎ নেড়ে যেতে হবে। দেখতে হবে পাক দিতে দিতে দুধ আর নারকোল মিশে গিয়ে যেন ক্ষীরে হয়ে উঠছে।

সেই সঙ্গে খেয়াল করতে হবে যে পাত্রে আপনি এই মিশ্রণটি তৈরি করছেন সে পাত্রের তল যেন পুড়ে না যায়। যতক্ষণ না আঠা আঠা ভাব তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পাক দিয়ে যেতে হবে। তারপর নামাবার আগে ছোট এলাচের গুঁড়ো ওই মিশ্রণের ওপরে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই সঙ্গে কিসমিস। যদি কেউ কাজুবাদাম দিতে পছন্দ করেন, দিতে পারেন। তবে মাকে দেখতাম কাজুবাদাম না দিতে। তারপর থালির মধ্যে ওই আঠা আঠা মিশ্রণটি ছড়িয়ে দিতে হবে। মিশ্রণটি রাখার আগে থালির মধ্যে ভালো করে ঘি মাখিয়ে রাখতে হবে। ঘি মাখানো থালাটির ওপরে মিশ্রণটি ছড়িয়ে দিতে হবে। তারপর ওই মিশ্রণ হাত দিয়ে চেপে দিতে হবে।

ঠান্ডা হলে বরফি আকারে কেটে নিলেই নারকোলের তক্তি তৈরি। মনে আছে এই নারকোলের তক্তি বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। আমার গুরুজী আচার্য পন্ডিত জয়ন্ত বসু যখন প্রথম বিদেশ গিয়েছিলেন তার সাংঘাতিক সফরে তখন এই বিজয়ার মিষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। মার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন এই মিষ্টি। অর্থাৎ নারকোলের তক্তি হয়েছিল তার সফর সঙ্গী। আজ মায়ের অনেকটাই বয়স হয়েছে। নিজে হাতে করে উঠতে পারেন না। কিন্তু সেই গন্ধ বিজয়া আসলেই মনে পড়ে যায়। তাই আমি চেষ্টা করি সেই পরম্পরাকে ধরে রাখার, আমার মত করে।