রাজ্যের খবর

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের জনক অদ্রীশ বর্ধন

Adrish Bardhan, the father of science fiction in Bengali literature

রাজু পারাল: ‘কল্পবিজ্ঞান’ কথাটি কল্পনা আর বিজ্ঞানের মিশ্রিত শব্দ। বিজ্ঞান যেখানে আবিষ্কারের সম্ভার নিয়ে পৌঁছতে পারে না, লেখক সেখানে কল্পনায় ভর করে সহজেই পৌঁছে যান। কল্পবিজ্ঞানের অগ্রদূত অদ্রীশ বর্ধন এই কাজটি করেছিলেন সফলভাবে। নিজের লেখার বৃত্তে একদিকে একাধিকবার যেমন নিয়ে এসেছেন বিজ্ঞান পিপাসু পাঠকদের, অন্যদিকে এনেছেন তেমনি রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনীর পাঠকদের।

কেবলমাত্র ‘কল্পবিজ্ঞান’ নিয়ে সাহিত্যরচনাই নয়, বাংলায় প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করার অগ্রদূতের ভূমিকাটিও তিনি পালন করেছিলেন সুদক্ষতার সঙ্গে। সম্পাদক, প্রকাশক, লেখক, অনুবাদক – এরকম বহু বিশেষণে ভূষিত করলেও আজীবন তিনি থেকে যাবেন সাহিত্যের অঙ্গনেই। যে সময়টায় সমগ্র উপমহাদেশে কল্প-বিজ্ঞান নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবতে পারেনি কেউ। সে সময় তরুণ সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধন এগিয়ে এসেছিলেন কল্প-বিজ্ঞানের ধারণা নিয়ে। অবশ্য সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র উৎসাহিত করেছিলেন কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখার।

অদ্রীশ বর্ধনের নিজের কথায়, ‘জানতাম ওই ধারার লেখা সবচেয়ে অবহেলিত। কিন্তু সেটাই আমার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওটাই যখন অবহেলিত, তখন ওটাই আমি লিখব।’ অদ্রীশের জীবনে এই অপরিসীম জেদ আর চ্যালেঞ্জের মানসিকতা প্রতি ধাপে দেখা যায়। অদ্রীশ বর্ধনের জন্ম উত্তর কলকাতায়, ১৯৩২ সালের ১ ডিসেম্বর। বাবা অনিল বর্ধন ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ঠাকুরদা চন্ডীচরন বর্ধন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার বউবাজারের সার্পেন্টাইন লেনে ‘হিন্দু বয়েজ স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

বাল্যকালে অদ্রীশের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় সেই স্কুলেই। পরে তিনি রিপন কলেজ (বর্তমানে, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক হন। শৈশবে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় অদ্রীশ মাত্র আশি টাকা সম্বল করে বোম্বাই (মুম্বাই) পাড়ি দেন। শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ পড়েই নাকি কলকাতা ছেড়েছিলেন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় অদ্রীশ। পরে ‘ক্যালকাটা কেমিক্যাল’-এ কাজ নিয়ে পোস্টিং হন বেঙ্গালুরুতে। তখন থেকেই চাকরির সূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন সারা ভারতে। সঞ্চয় করেছেন নানা অভিজ্ঞতা। ছয়ের দশকে সব ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। ততদিনে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখে হাত পাকিয়েছেন তিনি। তাঁর কলমের যাত্রা শুরু হয় ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার পাতায়।

ষাটের দশকে মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার তখন স্বর্ণযুগ। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক ওই পত্রিকায় রহস্য কাহিনী লিখতেন তখন। ছায়াছবি-খ্যাত গীতিকার প্রণব রায় রহস্য কাহিনী লিখনে দক্ষ ছিলেল সেই সময়ে। অদ্রীশ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করেন এবং তাঁরই লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করেন রহস্য রচনায়। ডাকযোগে পাঠানো অদ্রীশের লেখা ‘ব্রোঞ্জের গণেশ’ উপন্যাসটি ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে তাঁর অনেক লেখাই ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

বোম্বাইতে থাকাকালীন পুনেতে অদ্রীশ তাঁর প্রিয় লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন। পরে শরদিন্দু কলকাতায় থাকাকালীন অদ্রীশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়। শরদিন্দুর দেখাদেখি তিনি ‘মেডিক্যাল লিটারেচার’ পড়া শুরু করেন, কারণ গোয়েন্দা হতে গেলে শারীরবিদ্যা ও ঔষধ রসায়নের প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি জানা চাই আর গোয়েন্দা কাহিনীর লেখককেও গোয়েন্দা হতে হয়। এভাবেই অদ্রীশ সৃষ্টি করেন রহস্যসন্ধানী ইন্দ্রনাথ রুদ্রের, যার সহকারি ছিলেন লেখক মৃগাঙ্গ রায়। সম্ভবত এখানেই ব্যাোমকেশ-অজিত জুটির স্মৃতি কাজ করেছিল। ইন্দ্রনাথ-মৃগাঙ্গ লেখা জুটি নিয়েই অদ্রীশ লিখেছিলেন উপন্যাস ‘রুপোর টাকা’ যা ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে ওই প্রকাশনী থেকেই উপন্যাসটি বই হয়ে বেরোয়।

অদ্রীশের মৌলিক রহস্য কাহিনীগুলিকে কেউ কেউ বিদেশি থ্রিলারের অনুকরণ বলে মনে করলেও রহস্য কাহিনীর একনিষ্ঠ পাঠকদের প্রশংসা পেয়েছে প্রচুর। লেখকের ভাষাশৈলী এবং কাহিনীর বুনন যথেষ্ট বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। সেদিক থেকে তাঁকে ধ্বনিময় ভাষা ব্যবহারের অন্যতম পথিকৃৎ হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কল্পবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে একসময় তিনি অনুবাদের কাজও শুরু করেন। তাঁর অনুবাদ সম্ভারের মধ্যে কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর প্রাধান্য থাকলেও বিচিত্রধর্মী রোমাঞ্চ জগতের কাহিনীও সেখানে উপস্থিত। তাঁর অনুবাদ কর্মের সেরা দুটি বৃহৎ কাজ হল আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের আখ্যানগুলি এবং ভার্ণের বিচিত্র বিজ্ঞানভিত্তিক অভিযান কাহিনীগুলির রূপায়ন।

কল্পবিজ্ঞানের প্রতি প্যাশন থাকায় ১৯৬৩ সালে শুরু করেছিলেন কল্পবিজ্ঞানের বাংলা পত্রিকা ‘আশ্চর্য ‘। প্রশ্রয় পেয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত মানুষদের। প্রকাশক ছিলেন অদ্রীশের দাদা ড.অসীম বর্ধন। সম্পাদক অদ্রীশ বর্ধন এখানে ছদ্মনামের আড়ালে রইলেন। নাম নিলেন ‘আকাশ সেন’, প্রধান উপদেষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক সত্যজিৎ রায়। পত্রিকা প্রকাশ হতো বাড়ির একতলায় রাখা প্রেস ‘দীপ্তি প্রিন্টার্স’ থেকে। ‘আশ্চর্য’ -এর পাতায় সে সময়ে স্থান পেয়েছিল কল্পবিজ্ঞানের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, বই ও সিনেমার সংবাদ, ধারাবাহিক উপন্যাস, কমিকস্ ইত্যাদি।

পত্রিকাটিতে নিয়মিত লিখে গেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিৎ রায়, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ন ভট্টাচাৰ্যের মতো নাম করা কল্পবিজ্ঞান লেখকেরা। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সঙ্গে একঝাঁক নতুন লেখক- এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, ড.দিলীপ রায়চৌধুরী, বিশু দাস, গুরুনেক সিং, সমরজিৎ কর, শ্রীধর সেনাপতি, রনেণ ঘোষ প্রমুখদের সুযোগ দিয়েছিলেন অদ্রীশ।

১৯৭২ সালে , বিয়ের মাত্র দু’বছরের মাথায় অদ্রীশের পত্নী বিয়োগ হলে তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরামর্শে সংসারে মন দেন। কারণ তাঁর ছেলের বয়স তখন মাত্র এক বছর। এক বছরের ছেলেকে দেখাশোনায় বেশি সময় ব্যয় করতে হবে বলে অদ্রীশ নিরুপায় হয়ে পত্রিকা মুদ্রণ বন্ধ করে দেন। বন্ধ হয়ে যায় ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য’।

পরের দিকে অদ্রীশ বর্ধন মন দিয়েছিলেন অনুবাদের কাজে। সে সময়ে শার্লক হোমস, এইচ.জি.ওয়েলস, জুল ভার্ন, এডগার রাইজ বারোজ-এর ‘টারজান’, এডগার অ্যালান পো -এর রচনা সমগ্র অনুবাদ করেন তিনি। অদ্রীশ বর্ধনের সম্পর্কে বলা যায়, কল্পবিজ্ঞান না লিখলেও কেবলমাত্র অনুবাদের কাজের জন্যই অনায়াসে পাঠকদের মন জয় করতে পারতেন তিনি।

১৯৭৫ সালে অদ্রীশ বর্ধন নতুন উদ্যমে সৃষ্টি করেন ‘ফ্যান্টাসটিক ‘ পত্রিকা। তবে ওই পত্রিকা কেবল কল্পবিজ্ঞানের জন্য ছিল না। সত্যজিৎ ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের নির্দেশে নতুন পাঠকদের জন্য স্থান পেল ফ্যান্টাসি এবং ভূতের গল্প। লিখতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অনীশ দেব ও সিদ্ধার্থ ঘোষের মতো নামজাদা সাহিত্যিকরা। অদ্রীশের প্রেস থেকেই প্রকাশিত হতো ‘ফ্যান্টাসটিক’পত্রিকাটি।

সহ সম্পাদক ছিলেন তাঁর পরম সুহৃদ রণেন ঘোষ। নিয়মিত লেখা ও লেখকের অভাবে পত্রিকাটি দুর্বল হয়ে পরে শেষপর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে অদ্রীশ যোগ দেন ‘ইত্যাদি প্রকাশনী’তে সম্পাদক হিসেবে। পরের দু’বছর ‘কিশোর মন’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। কিন্তু সে কাজে বেশিদিন মন টেকেনি তাঁর। চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুনরায় ফিরে আসেন ‘ফ্যান্টাসটিক’এর কাজে।

সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের জন্যে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। অনুবাদের জন্যে পেয়েছেন ‘সুধীন্দ্রনাথ রাহা’ পুরস্কার, ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পুরস্কার, ‘দিনেশ চন্দ্র স্মৃতি ‘ পুরস্কার, ‘মৌমাছি স্মৃতি’ পুরস্কার, ‘রোটারি স্মৃতি’ পুরস্কার, ‘কল্পবিশ্ব সম্মাননা’ ইত্যাদি।

জীবনের শেষ দিকে তাঁর কেটেছে চরম দারিদ্র ও অসুস্থতার মধ্যে। পাশে পেয়েছিলেন সামান্য কিছু পাঠক ভক্তকে। অবশেষে ২১ মে রাত একটায় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের নিজের বাড়িতে ৮৬ বছর বয়সে অন্য এক জগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন কল্পবিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ অদ্রীশ বর্ধন।
লেখক – বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক