ভ্রমণ

ইতিহাসের চোরাগলিতে দার্জিলিং

Tourism of West Bengal

The Truth of Bengal: দার্জিলিং শব্দটির মানে বজ্রধ্বনির ভূমি। দার্জিলিং শব্দটি এসেছে তিব্বত থেকে দোর্জে অর্থাৎ বজ্রধ্বনি এবং লিঙ্গ শব্দের অর্থ ভূমি। আসলে দার্জিলিঙের মাধুর্য লুকিয়ে রয়েছে, হিমালয় পর্বতমালার পটচিত্রে। ভূমণ্ডলে তরুণতম পর্বতগুলির অন্যতম হিমালয়। বয়সে তরুণ হলেও, এর বিশালতা অতুলনীয়। ভূতাত্ত্বিকদের মত, হিমালয়ের বয়স ১২০ কোটি বছর। কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের বেশ কিছু চূড়াকে দেখা যায় বলেই হয়তো, দার্জিলিং শহর রূপে গড়ে উঠেছিল। ক্যুইন অফ দ্যা হিল স্টেশন বলে এর উদাহরণও দেওয়া হয়েছিল। এক ইংরেজ সাহেব ফ্রান্সিস ইয়ং হাসব্যান্ড বলেছিলেন, স্বাভাবিক সৌন্দর্যের দার্জিলিং এর ধারে কাছে যায় এমন জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখন হয়তো সেই ছবিটা অনেক পাল্টেছে, লাগামছাড়া গতিতে বেড়েছে জনসংখ্যা, নগরায়ণ, পর্যটনের চাহিদায়, আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে হোটেল, লজ। ফলে শতাব্দীর আগে থাকা প্রকৃতিক চিত্র আজ অনেকটাই ধূসর।

বলা বাহুল্য, দার্জিলিং শহরের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল ইংরেজদের হাত ধরেই। ১৮২৯ সাল, দার্জিলিং তখন একটা পাহাড়ি অজ পাড়াগাঁয়ের মতো। সেই সময় শ খানেক মানুষ বসবাস করতেন দার্জিলিং-এ। সেই সময় নেপাল সিকিম সীমান্তে কিছু গণ্ডগোল দানা বাঁধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে, পাঠানো হয় দুই সাহেব অফিসারকে। তার আগে, ১৮১৬ সালে সিকিমসহ পুরো এলাকাই ছিল নেপালের জবরদখলে। গোর্খাদের সীমান্ত নীতি ইংরেজদের মনপসন্দ না হওয়ায়, নেপালের বিরুদ্ধে দুবার সৈন্য পাঠায় ইংরেজরা। দ্বিতীয়বার ইংরেজদের কাছে হার স্বীকার করে নেপাল। দার্জিলিং-এর প্রসঙ্গ বলতে গেলে একটু বিস্তারিত ভাবে সিকিমের প্রসঙ্গ আনতেই হয়। ১৮১৪-১৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালে যুদ্ধ হয়, সেখানে নেপাল হেরে যায়, এবং একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার নাম ট্রিটি অফ সুগৌলি। এই সময় সিকিমের সঙ্গেও একটি চুক্তি করে ব্রিটিশরা। নাম ট্রিটি  অফ তিতালিয়া। চুক্তি অনুসারে সিকিমের যে সীমানা ছিল তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় নেপাল। অন্যদিকে সিকিমের কাছে দার্জিলিং নেওয়ার চুক্তি করে ব্রিটিশরা। বছরে ৬ হাজার টাকার নজরানায় ব্রিটিশদের হাতে দার্জিলিং তুলে দেয় সিকিমের রাজা।

ব্রিটিশদের এই হিল স্টেশনের প্রয়োজন ছিল, ছুটি কাটানো ও চা শিল্পের জন্য।  ব্রিটিশরা সিকিমকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দিলেও সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। কারণ ইংরেজরা বাৎসরিক যে ৬ হাজার টাকা তুলে দিত সিকিমের রাজাকে, তা একটা সময় বন্ধ করে দেয়। এর পরেই সিকিমের রাজা দার্জিলিং-এ অস্থিরতা তৈরি করে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এতোটাই বোগতিক হয় যে, ১৮৫০ সালে এবং ১৮৬২ সালে দুবার সেনা পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। ব্রিটিশরা অবশ্য আবার বাৎসরিক টাকা দিতে থাকে, তার পরিমাণ ছিল বছরে ১২ হাজার টাকা। কিছু সময় পরে ইংরেজরা দাবি করে, সিকিমকে তারা রক্ষা করছে, এটি ব্রিটিশদের প্রোটেক্টরেট এরিয়া। ১৮৯০ সালে এই স্টেটাস আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশও করে ইংরেজরা। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ এবং চিনের মধ্যে এক সন্ধি হয়, সেই চুক্তিতে বলা হয়, সিকিমের মধ্যে চিন ঢুকতে পারবে না এবং তিব্বতে ব্রিটিশরাও নাক গলাবে না। এর ফলেই সিকিমের রাজা স্বাধীন হলেও, ব্রিটিশদের দ্বারা প্রোটেক্টরেট ছিল। বস্তুত, সিকিমের রাজা বিদেশ নীতিতে স্বাধীন ছিল না, এবং নিজস্ব সেনা মোতায়েনের ক্ষমতাও ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলেও, ১৯৫০ পর্যন্ত এই আইন বলবৎ ছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র সিকিম রাজ্যই প্রোটেক্টরেট মর্যাদা পেতে থাকে, ভারতের আর কোনও রাজ্য তা পায়নি।

১৯৫০ সালে সিকিমের সঙ্গে ভারতের একটি নতুন চুক্তি হয়, সেখানেও তাদের প্রোটেক্টরেট মর্যাদায় রাখা হয়। চুক্তিতে বলা হয়, সিকিমের মধ্যে, ভারত সরকার কোনও প্রশাসনিক কাজ কর্ম প্রত্যক্ষভাবে করবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সিকিমে সংখ্যাগুরু ছিল নেপালি এবং শাসন চালাতো লেপচাগোষ্ঠীর রাজারা। সিকিমের জনসংখ্যা হারে বিচার করলে দেখা যাবে, সিকিমের প্রধান জনসংখ্যা ছিল নেপালি হিন্দু, দ্বিতীয় স্থানে বৌদ্ধ লেপচা। বোঝাই যাচ্ছে, সংখ্যা গুরু যারা তারা প্রজার ভূমিকায় আর সংখ্যালঘু আদি জনগোষ্ঠী রয়েছে শাসকের আসনে। সেখানেতো সমস্যা হওয়ারই কথা। আর সেটা শুরু হয়েছি ১৯৪০ এর সময় থেকেই। যখন ভারতে ইংরেজ তাড়াও আন্দোলন চরমে, সেই সময় সিকিমেও তার প্রভাব পড়ে। সিকিম রাজ্যে তৈরি হয় নতুন রাজনৈতিক দল সিকিম কংগ্রেস। যার নেতৃত্বে ছিল নেপালিরাই। তাদেরও দাবি ছিল, সিকিমে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করা হোক। রাজা থাকুন কিন্তু তার সঙ্গে সাংবিধানিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও হোক। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, সেই সময় সিকিমের রাজা ছিলেন তাশি নামগিয়াল। তাঁর সঙ্গে ১৯৫০ সালে ইন্দো সিকিম ট্রিটি স্বাক্ষর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। স্বাধীন ভারতেও সিকিমকে সেই প্রোটেক্টরেট তকমা জারি রাখা হয়।

এই সময় সিকিম কংগ্রেসের দাবি মেনে, রাজাও ঠিক করেন, সিকিমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে। সেই সময় সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন কাজি লেনডুপ দোরজি। এখানে রাজাও ছিল এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও চালু হল। যদিও ক্ষমতার দিক থেকে রাজাই ছিলেন প্রধান। যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতিতে অবশ্য ভারত সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। সিকিমের রাজা তাশি নামগিয়াল বিদেশ সফরে গেলেই, সিকিমকে আলাদা স্বাধীন রাজ্য বলে তুলে ধরতেন । এমনকী ভারতের পতাকাও ব্যবহার করতেন না। বিদেশে সবসময়ই প্রচার চালানো হত, সিকিম সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাষ্ট্র, যেন ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতো। আর এই বিষয়টিই ভালো ভাবে মেনে নেয়নি ভারত সরকার। ১৯৬৩ সালে তাশি নামগিয়ালের মৃত্যু হয়, ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যু হয়। এই সময় সিকিমে ক্ষমতায় বসেন তাশির ছেলে পালডেন থনডুপ নামগিয়াল। পালডেন ক্ষমতায় বসার পরেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। তাঁর এক তিব্বতী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, তিনি আর এক মার্কিনিকে বিয়ে করেন। নাম হোপ কুক। এই হোপ কুকের উপর অভিযোগ ওঠে, তিনি আসলে সি আই এ এজেন্ট। এবং জেনে বুঝেই সিকিমের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা এবং রাজাকে হাতের মুঠোয় করে নিজের ক্ষমতা পরিচালনা করেন। যদিও ১৯৭৩ সালে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এবং আমেরিকা ফিরে যান হোপ কুক। তিনি দেশে ফিরে বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। সেখানে দাবি করা হয়, সিকিম আলাদা একটি রাজ্য, ভারত সরকারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। এবং সেই লেখার মধ্যে ভারত বিরোধী কথাও ছিল। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কিছু জায়গায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে উত্তাল হয়ে ওঠে। তিব্বতে চিনের আগ্রাসন, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিজিমের রক্তক্ষয়ী উত্থান, এমনকী নেপালেও কমিউনিজিমের প্রভাব।

অন্যদিকে ১৯৬৭ সালে চিন, সিকিমকে প্রায় দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় ১০ দিন লড়াই চালিয়ে ভারতীয় সেনা চিনা ফৌজকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ১৯৭৩ সালে সিকিমে বিক্ষোভ বেশ জমাট বাঁধে। প্রধান ছিল সিকিম কংগ্রেস। একাংশের মত, সেই সময় রাজার ক্ষমতা খর্ব করে পুরোপুরি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করতেই এই বিক্ষোভকে ফান্ডিং করতো তৎকালীন ভারত সরকার। এ বিষয়ে ভারত সরকার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে কাজে লাগায়। এই পরিস্থিতির মধ্যে সিকিমের রাজা ভারতের কাছে সেনা পাঠানোর আর্জি জানায়। এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার অনুরোধ করে। সেই সময় ১৯৭৩ সালে মে মাসে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়, সিকিমে নির্বাচন হবে একদম ভিন্ন পদ্ধতিতে। ক্ষমতা পুরোপুরি থাকবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উপর। আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব নেবে সরকার। এই চুক্তির পরেই ভারতের তরফে একটি ড্রাফ্ট কন্সিটিটিউশন তৈরি করা হয়। আর এতেই আপত্তি জানায় চোগিয়াল। তার দাবি, নতুন সংবিধান হলে রাজার কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। এদিকে ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে যে নির্বাচন হয়, তাতে সিকিম কংগ্রেস প্রায় সব আসনেই জিতে যায়। এরা মূলত ভারত সরকারের পক্ষে ছিল। ওরা চাইতো, ভারত সরকারের আইন অনুসারেই চলুক সিকিম। অবশেষে ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, সিকিম নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হলেও, তার আঁচ সেভাবে কিছু পড়েনি দার্জিলিং-এ। ব্রিটিশদের বদান্যতার কারণেই দার্জিলিং আজও বাংলার অংশে রয়েছে, নয়তো সিকিমের অংশেই থেকে যেত। তবে দার্জিলিং-এর শীতল পরিবেশে, আটের দশক থেকে কম রাজনৈতিক ঝড় ঝাপটা যায়নি। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে চার দশক ধরেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের সাক্ষী থেকে দার্জিলিং। তবু আজও বাঙালিসহ দেশি বিদেশী পর্যটকদের কাছে প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে রয়ে গিয়েছে দার্জিলিং। এখানকার টয় ট্রেন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

Related Articles