অফবিট

নাগাল্যান্ডের ছাই চাপা রক্তক্ষয়ী এক ইতিহাস, বদলাচ্ছে মানসিকতা!

History of Nagaland

The Truth of Bengal: উত্তরপূর্ব ভারত, বঞ্চনা, অবহেলার প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই দিকের রাজ্যগুলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, কোনও আশঙ্কায় বারবার অবহেলার শিকার হয়েছে, উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি। অসম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং অরুণাচল। এই সাত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস যে রাজ্যগুলি লালিত পালিত করছে, তার মধ্যে অন্যতম, অসম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ড। আজকের ইতিহাস নাগাল্যান্ডের।

নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে একটি গ্রাম। নাম খোনোমা। দূরত্ব খুব বেশি নয়, রাজধানী থেকে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় ঘণ্টা খানেক। রাস্তায় চলার পথে দেখা মেলে একটি মেমোরিয়ালের, সেখানে লেখা রয়েছে, ‘নাগারা ভারতীয় নয়, তাদের বাসস্থানের সীমানা ভারত সরকারের অধীন নয়। আমরা এই চরম সত্যটির জন্য, যে কোনও মূল্যে লড়াই চালিয়ে যাবো।’ মজার ব্যাপার এই মেমোরিয়ালটি এখনও রয়েছে। আসলে এই মেমোরিয়ালের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে, এমন এক ইতিহাস ও তার ডালপালা, যা প্রত্যেক ভারতীয়কে জানা উচিত।

ভারতে যতগুলি অঙ্গরাজ্য রয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু রাজ্যের সংযুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিদ্রোহের ইতিহাস। নাগাল্যান্ড ব্যতিক্রম নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহের ইতিহাস কাশ্মীরের থেকেও পুরনো।

নাগাল্যান্ড সম্পর্কে জানতে গেলে, সবার আগে আমাদের জানতে হবে ওখানকার জনজাতি সম্পর্কে। নাগাল্যান্ডে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা কিন্তু ওখানকার আদি বাসিন্দা নয়। এখানে রয়েছে ১৬টির মতো ভিন্ন উপজাতি। তার মধ্যে দুটি উপজাতি নাগাই উপজাতি নয়। যেমন দিমাসা কাছারি এবং কুকি। এই ১৬টি উপজাতির যেমন ভিন্ন ভাষা রয়েছে, তেমনই রয়েছে ভিন্ন ধারার, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি।

১৮২৪ সাল। শুরু হল অ্যাঙলো বার্মিস যুদ্ধ। উত্তরপূর্ব ভারতের বেশ একটা বড় অংশে দখল জমায় ইংরেজরা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নাগা হিলস। যদিও বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত নাগা উপজাতিরা এই অঞ্চলে স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রশাসন চালাতো। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই উপজাতিরা একজোট হয়। ইংরেজরা ২০০০ নাগা উপজাতিদের ব্রিটিশ সেনায় নিয়োগ করে ফ্রান্সে পাঠায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। যুদ্ধের পর, তারা দেশে ফেরে। অন্যদিকে, ভারতে তখন দ্বিমুখী আন্দোলন শুরু হয়েছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। একদিকে নরমপন্থীদের আন্দেলন অন্যদিকে চরমপন্থীদের আন্দোলন। এই সময় নাগারা, কোনও আন্দোলনেই যোগ দেয়নি। তারা মনে করেছিল, ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে তারা যোগ দেবে না।

১৯১৮ সালে কয়েকটি নাগা উপজাতি মিলে একটি নাগা ক্লাব গঠন করে। যেহেতু এরা আগে থেকেই খ্রিস্টান ধর্ম নিয়েছিল, তাই একত্রিত হতে বেশি সময় লাগল না। ১৮৪০ সালে, আমেরিকান ব্যপ্টিস্ট মাইলস ব্রনসন ধর্মপ্রচারে অসম মিশনে ভারতে আসে। এবং নাগাল্যান্ডের জনজাতিদের মধ্যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে। সেই শুরু উত্তরপূর্ব ভারতের ধর্মান্তকরণ।

১৯২৯ সালে সাইমন কমিশন ভারতে আসে। সেই সময় নাগা ক্লাবের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, ভারতের সঙ্গে তারা যুক্ত হতে চায় না। ব্রিটিশদের সঙ্গেই তারা থাকতে চায়। তাদের যুক্তি ছিল, নাগাবাসীদের সঙ্গে মূল ভারত ভূখণ্ডের ভাষা, সংস্কৃতির কোনও মিল নেই, তাই তারা স্বতন্ত্র। তারা হিন্দু বা মুসলিম নয়, তারা যেহেতু গরু ও শুয়োরের মাংস খায় বলে, তাই তাদের ভালো নজরে দেখা হয় না।

১৯৩৫ সাল।  পাস হয়, গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট। সেই সময় ব্রিটিশরা ইচ্ছাকৃতভাবেই নাগা হিলসকে এই আইনের বাইরে রাখা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, মূল ভারত থেকে উত্তরপূর্ব ভারতকে বিভাজন করা যায়, এদিকে ভারতে তখন জোরদার হচ্ছে দ্বিমুখী স্বাধীনতা আন্দোলন। এই সময় নাগা ক্লাবও একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরু করে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল বা এন এন সি। ভারতের যখন ইংরেজ বিরোধী কর্মকাণ্ড তৈরি হচ্ছে, দেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে সংগ্রেম চলছে, সেই সময় সমান্তরাল ভাবে একদম ভিন্ন একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে দাবি তুলতে থাকে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যেমন কংগ্রেসের মধ্যে চরম ও নরমপন্থী ধারা দেখা গিয়েছে।  নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের মধ্যেও তেমন দুটি ধারার উদয় হল।  সেই সময় ভারত সরকার এন এন সি-র নরমপন্থী নেতা টি সাকরি ও টি এন অঙ্গামির সঙ্গে কথা বার্তা শুরু হয়। সেই সূত্র ধরেই ১৯৪৭ সালে ২৮ জুন নাগাল্যান্ড ভারত সরকারের অধীন হয়।

দেশের সঙ্গে একটি রাজ্যের সংযুক্তির ইতিহাস এখানে শেষ হলে ভালোই হত, কিন্তু সংযুক্তির পর মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এন এন সির চরমপন্থীরা। তার অন্যতম নেতা ছিল অঙ্গামি জাফো ফিজো। ফিজো কখনই চাইত না, নাগাল্যান্ডের সংযুক্তি ভারতের সঙ্গে হোক।  ফিজো প্রকাশ্যে বিবৃতিও দিয়েছিল সাদা চামড়ার সরকারের পরিবর্তে তারা কালো চামড়ার সরকার চায় না।

নাগাল্যান্ডকে স্বাধীন রাখার লক্ষ্যে নিয়ে ফিজো মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই বৈঠকে গান্ধী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নাগারা যদি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে না চায়, তাহলে  জোর করা হবে না। আর সেনা পাঠিয়ে জোর করে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হলে, সবার আগে তাঁর বুকে গুলি চলবে। যদিও জওহরলাল নেহেরু ও ভারতের কন্সিটিটিউট অ্যাসেম্বলি গান্ধীর পক্ষে ছিল না। নেহেরুর ধারণা ছিল, ভারত-চিনের মধ্যে যে কূটনৈতিক চাপান উতোর চলছিল, তাতে নাগারা চাপ সঙ্য করতে পারবে না। ফলে তারা নিজেরাই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আর্জি রাখবে।  কিন্তু ফিজো এমন একটা কাণ্ড ঘটালো, যা নেহেরু কল্পনাও করতে পারেনি।  ভারতের স্বাধীনতার হস্তান্তর হওয়ার আগের দিনই, ১৪ অগস্ট ১৯৪৭ সালে ফিজো ঘোষণা করে নাগাল্যান্ড স্বাধীন। পাশাপাশি ১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা উদযাপনকে তারা বয়কটও করে। যদিও নেহেরু বিষয়টিকে তেমনভাবে গুরুত্ব দেননি।

১৯৫২ সালে নাগা আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ বাড়ানোর খেলা শুরু হয়। এনএনসি নাগাল্যান্ডে একটি গণভোটের আয়োজন করে। দাবি ছিল, ৯৯.৯৯ শতাংশ বাসিন্দা স্বাধীন নাগাল্যান্ডের পক্ষে। এবং ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনকে তারা পুরোপুরি বয়কট করছে। ১৯৫৩ সালে জওহরলাল নেহেরু নাগাল্যান্ডে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন বার্মার প্রধানমন্ত্রী। সেই সময়, জনসভায় নেহেরুকে দেখে ব্যাপক টিটকিরি মারে এনসিসি-র কর্মী সমর্থকেরা। বিষয়টি ভালো ভাবে নেননি নেহেরু।

নাগা হিলসে পাঠানো হয় সেনা। ভারতীয় সেনার সামনে প্রবল বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে মারা যান অনেকে। এর পর থেকেই এনএনসি-র নরম ও চরমপন্থীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে নরমপন্থী নেতা টি সাকরিকে গুলি করে হত্যা করে চরমপন্থীরা। ঘটনার পর ব্যাপক রাজনৈতিক জলঘোলা শুরু হয় নাগাল্যান্ডে। এদিকে ফিজো পূর্ব পাকিস্তানের সহায়তায় লন্ডনে পালিয়ে গা ঢাকা দেয়। অবশ্য যাওয়ার আগে, গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ হিসেবে নাগাল্যান্ডকে ঘোষণা করে। পাশাপাসি একটি গেরিলা সেনাবাহিনিও গঠন করে।

সময়ের সঙ্গে নাগাল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা তলানিতে ঠেকতে শুরু করে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভারত সরকার আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (১৯৫৮) বা আফস্পা আইন পাস করায়। সেনার অধীনে ছেড়ে দেওয়া হয় নাগাল্যান্ডকে। এই সময়ে, ভারতীয় সেনা ব্যাপক অভিযান চালায়, মারা যান বহু মানুষ মারা যান। ১৯৫৬-৫৮ সালের মধ্যে প্রায় ১৪০০ নাগা নাগরিক মারা যান। পরিবেশ পরিস্থতি বেগতিক দেখে, এনএনসির বহু সদস্য বিকল্প রাস্তার খোঁজ করতে থাকেন, শান্তি ফেরাতে উদ্যোগী হয় তারা। এনএনসির একটা বড় নেতৃত্ব মিলে এন পি সি বা নাগা পিপলস কনভেশন গঠন করে।

তার মধ্যে ভিন্ন উপজাতির প্রতিনিধিরা ছিলেন। অবশেষে এনপিসি ভারত সরকারের সঙ্গে মিলে মিশে কাজ শুরু করার ইচ্ছাপ্রকাশ করে। ১৯৫৯ সালে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়,  নাগা হিলস নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য তৈরি করা হোক। সেই প্রস্তাব মেনে নেয় ভারত সরকারও। সংবিধানে সংশোধনীও আনা হয়, অবশেষে ১৯৬৩ সালে নাগাল্যান্ড আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি অঙ্গরাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

Related Articles