
The Truth of Bengal: ওয়াজেদ আলি শাহ-র রাজকীয়তা আর ‘অবধি’ খাবারের ঐতিহ্যই আজও রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেলের তুরুপের তাস।লখনৌতে গিয়ে ‘অবধি বিরিয়ানি’ আর ‘গালায়টি কাবাব’ না খেলে যেমন জীবন বৃথা, তেমনই আপনার কলকাতার বিরিয়ানির কথা মনে পড়ে যাবেই। গত রবিবার লখনৌতে বিরিয়ানি খেতে খেতে আমারও কলকাতার বিরিয়ানির কথা মনে পড়ল, আর পড়বে নাই বা কেন, অবধি বা অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে যখন ব্রিটিশরা নির্বাসন দিয়ে কলকাতায় পাঠালেন, তাঁর সঙ্গে যে পাইক-বরন্দাজ-বাবুর্চিরা কলকাতায় চলে এলেন, তাঁরাই তো এই শহরের খাদ্যাভ্যাসকে একদম বদলে দিলেন। আর কলকাতাও শিখল বিরিয়ানি আর মাংসের হরেক রকম পদ খেতে। আজকের কল্লোলিনী তিলোত্তমা যে বিরিয়ানির জন্য সমধিক পরিচিত, সেটা তো লখনৌ ওয়াজেদ আলি শাহ’র সঙ্গে এই ঐতিহাসিক যোগাযোগের কারণেই। বিরিয়ানি আর অবধি এর রান্নার কথা বললেই কলকাতা শহরের যে রেস্তোরাঁর নাম প্রথম মাথায় আসে, সেটা অবশ্যই রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল। কলকাতার খাওয়া- দাওয়ার ইতিহাসে বিরিয়ানি বা মাংসের বিভিন্ন পদের ‘অবধীয় প্রবেশ’-এর যদি দুশো বছর কেটে গিয়ে থাকে, তা হলে চিৎপুরের ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’-এরও বয়স একশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে।
এখন অবশ্য শহরে ‘রয়্যাল’-এর অনেক শাখা, এমনকি পার্ক সার্কাসে ট্রাম ডিপোর বিপরীতেও শতাব্দী প্রাচীন এই খানদানি রেস্তোরাঁর একটি নবীন ঝকঝকে ‘পেপার ব্যাক’ সংস্করণ এসে গিয়েছে। পার্ক সার্কাসের ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ দেখতে শুনতে যতটাই ঝকঝকে হোক, এখনও অনেকের কাছে ‘রয়্যাল’ বলতে চিৎপুরে রবীন্দ্র সরণীতে ট্রাম রাস্তার উপরে সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত ফুড আউটলেট। চিৎপুরের ‘রয়্যাল’-এ বসে খাওয়ার একাধিক ধরনের বন্দোবস্ত রয়েছে, উপরে সপরিবারে খাওয়ার জন্য আলাদা শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাও অনেকদিন ধরে চালু। কেন ‘রয়্যাল’ এত বিখ্যাত? চিৎপুরের পুরোনো এই রেস্তোরাঁকে ঘিরে খাদ্য রসিকদের কেন এত রোমান্টিকতা বা উচ্ছ্বাস? ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’-এর দুটি খাবার নিয়ে মূলত সকলের উচ্ছ্বাস এবং দেশজোড়া খ্যাতি। প্রথমটি মটন বিরিয়ানি এবং মটন চাপ। ভোজন রসিকরা বারে বারে ফিরে আসেন এই খানদানি রেস্তোরাঁর মটন বিরিয়ানি আর মটন চাপ খেতে, তার সঙ্গে শেষ পাতে শাহি টুকরা থাকলে ‘লা জবাব’। এমন নয় যে ‘রয়্যাল’-এর চিকেন বিরিয়ানি বা চিকেন চাপ-এর কাটতি কম, কিন্তু একেবারে ছোট-ছোট টুকরোই সাজানো মটন চাপ আর তার গ্রেভির স্বাদ যিনি একবার নিয়েছেন, তিনিই জানেন আসলে এটা কতটা নেশার মতো। মটন বিরিয়ানিতেও সেই লখনৌয়ের সুবাস, যাবতীয় মশলার মিশেল যেন আজও চিৎপুরের এই রেস্তোরাঁ ধরে রেখেছে। আসলে গত শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় নামকরণের মধ্যে দিয়েই যে রাজকীয় আভিজাত্যের ঘোষণা ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ রেখেছিল, শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও তার আকর্ষণ আজও অনুরাগীদের কাছে অম্লান। ‘রয়্যাল’-এর জাদুটা কী? যেটা ‘অবধি’ খাবারের বিশেষত্ব, অর্থাৎ নবাব পরিবারের অনুকরণে যে রান্নাটা লখনৌতে শুরু হয়েছিল, মাংসকে এতটা নরম এবং তুলতুলে করে নিয়ে যাওয়া, যাতে মুখে দিলে গলে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি পাওয়া যায়, এটাই কলকাতা শহরের ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ পরিচিত করায়।
এই যে ‘খানা’য় রাজকীয় ছোঁয়া, এবং মেজাজও, সেইজন্যই ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’। ‘রয়্যাল’-এর মটন বিরিয়ানিতে আলু থাকে না, বরং থাকে পর্যাপ্ত মাংস, আর দিলখুশ করে দেওয়া সুবাস তেমনই মটন চাপেও নরম ‘মটন’কে একেবারে ছোট-ছোট টুকরোতে গ্রেভিতে সাঁতলে নিয়ে প্লেট উপচে দেওয়াটাই ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ এর দস্তুর। এই যে পুরো খাওয়াদাওয়ার অভিজ্ঞতা মেজাজটার মধ্যে একটা রাজকীয় স্পর্শ, তারই উদাহরণ শেষপাতের মিষ্টিটাও, অর্থাৎ ‘শাহি টুকরা’ আপনি প্রতিনিয়ত অনুভব করবেন নবাবী খানাপিনার অভিজ্ঞতাটাকে আপনার সামনে পেশ করা হচ্ছে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে ‘রয়্যাল’ কলকাতাকে এই যে খানদানি অভিজ্ঞতার পরশ দিয়েছিল, তা আজও অব্যাহত। ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ এর মটন চাপ আপনি নরম রুমালি রুটি কিংবা চমৎকার তন্দুরি রুটি দিয়েও চাখতে পারেন। আগেই বলেছি অন্য সব লোভনীয় ‘ডিশ’ এও যে ‘রয়্যাল’ এর খ্যাতি নেই এমনটা নয়, মটন বিরিয়ানি আর মটন চাপ ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাইকেল হোল্ডিং আর জোয়েল গার্নারের মতো বিধ্বংসী ‘জুটি’ খাদ্য রসিকদের উইকেট তুলে নিয়ে যাবেই। কিন্তু ক্যারিবিয়ান পেস বোলিংয়ে যেমন তার পিছনে অ্যান্ডি রবার্টস বা ম্যালকম মার্শালের বিপজ্জনক সুইং ছিল, তেমনই ‘রয়্যাল’-এরও মটন চাপের পিছু পিছু চিকেন তন্দুরি বা চিকেন চাপের ‘ডেলিভারি’ আছে, যাতে ব্যাট, পুড়ি, প্লেট না পেতে দেওয়াটা মুশকিল।আমি নিজে এখনও চিৎপুরেই যেতে বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য পার্ক সার্কাসের হাল ফ্যাশনের ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান হোটেল’ও সেরা খাবারের ঠিকানা হতে পারে।