রান্নাঘর

শতবর্ষ পেরনো বাগদাদি ইহুদিদের যে দোকানের কেক ছাড়া বাঙালির বড়দিন অসম্পূর্ণ

Bengali Christmas is incomplete without cake

The Truth of Bengal,Mou Basu: বাগদাদের রাস্তায় রাস্তায়, বাড়ি বাড়ি মাথায় কেক ও বেকারির নানান পসরা সাজিয়ে বিক্রি করতেন নাহুম ইজরায়েল মোর্দেকাই। ভাগ্য অন্বেষণের লক্ষ্যে তিনি নিজের শহর ছেড়ে চলে আসেন অচেনা অজানা শহর কলকাতায়। কলকাতা তখন ব্রিটিশ শাসনাধীন। না, অচেনা অজানা শহর কলকাতা খালি হাতে ফেরায়নি নাহুম ইজরায়েল মোর্দেকাইকে। ২ হাত ভরে আপন করে নিয়েছে বাগদাদি ইহুদিকে। সালটা ১৯০২। প্রথমবার কলকাতার খাদ্যরসিকদের জিভে ঠেকে বাগদাদি ইহুদির নানান সুস্বাদু কেক, বেকারির পদ ও চিজ। তবে তখন তিনি মাথায় ঝাঁকা নিয়ে নিজের হাতে তৈরি খাবার বিক্রি করতেন। ধীরে ধীরে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খাবারের সুখ্যাতি। প্রায় ১৪ বছর পর ব্রিটিশদের তৈরি তৎকালীন হগ মার্কেট যা এখনকার নিউ মার্কেট বলে পরিচিত সেখানেই ১৯১৬ সালেই গড়ে তোলেন নিজের দোকান। নাম দেন, ”Nahoum’s and Sons bakery”।শতবর্ষ পেরনো সেই কেকশপ বা কেকের দোকান এখনো চলছে।এই দোকানের কেক ছাড়া বাঙালির বড়দিন অসম্পূর্ণ। পুরনো নিউ মার্কেটের এই দোকানে গেলে এখনো নজরে পড়বে টিকউডের পুরনো নকশাদার আসবাবপত্র। পুরনো কলকাতার চার্ম খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু দোকান সামলেছেন নাহুম ইজরায়েল নিজে। এরপর দোকান সামলেছেন নাহুমের ছেলে এলিয়াস। বাবার মৃত্যুর পরে নিজেদের বিখ্যাত কেকের দোকান সামলাতেন এলিয়াসের ছেলে ডেভিড নাহুম। ২০১৩ সালে প্রয়াত হন ডেভিড।

এরপর দোকানের পুরনো কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে দোকান সামলাতেন ডেভিডের ভাই আইজ্যাক। দ্বীপ বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরাক আর সিরিয়া থেকে বহু ইহুদি কলকাতায় চলে আসেন। তাঁদের সঙ্গেই কলকাতায় এসেছিলেন নাহুমের প্রতিষ্ঠাতা নাহুম ইজরায়েল মোর্দেকাই। তাঁর হাত ধরেই কেকের পাশাপাশি কলকাতায় জনপ্রিয়তা লাভ করে বাকালাভা, চাল্লাহ ব্রেডের মতো ইহুদি ও পশ্চিম এশিয়ার নানান মিষ্টি খাবার। বড়দিনের সময় ক্রেতাদের লাইন পড়ে যায় নাহুমের কেকশপের সামনে। শুধু বড়দিন নয় সারাবছরই বেস্টসেলার হয়ে বিক্রি হয় রিচ ফ্রুট কেক, রিচ পাম কেক। এছাড়াও লেমন টার্ট, চিকেন প্যাটি, রোমান রিংস, রামবল, ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রি, বাকালাভা, মার্জিপান ক্যান্ডি, মাদেইরা কেক, চিজ সামোসা, ম্যাকারুন, আমন্ড পেস্ট্রি, স্প্রিং অনিয়ন বিস্কুট, কুকিজ বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়। বড়দিন মানেই কেক। খাদ্য ঐতিহাসিকদের মতে বড়দিনে কেক খাওয়া হলেও কেক কিন্তু প্রথমে ইংরেজরা তৈরি করেনি। প্রাচীন মিশরে বেক করার পদ্ধতি ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেককে ফাঁপা ও হালকা করতে ব্যবহার করা হত ইস্ট। রোমান সাম্রাজ্যের আমলে অলিভ অয়েল কেক তৈরির প্রচলন ছিল। খ্রিষ্ট পূর্বের চতুর্থ শতকে প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যেও কেকের প্রচলন ছিল। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারিতে বলা হয়েছে ১৩ শতকে প্রথম বার কেক শব্দ বলা হয়েছে। কেক শব্দটি এসেছে কাকা শব্দ থেকে। মধ্য যুগে ইংরেজ বেকাররা জিঞ্জার ব্রেড বা আদা দিয়ে তৈরি পাঁউরুটি আর ফ্রুট কেক তৈরি করতেন। ১৭ শতকের মাঝামাঝি সময় ইউরোপে আধুনিক স্টাইলে কেক তৈরির প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ এসময় কেক তৈরির ছাঁচ, গুঁড়ো চিনির ব্যবহার করা শুরু হয়। কেক তৈরির ছাঁচ হিসাবে ব্যবহার করা হত ধাতু, কাগজ, কাঠ। কেকের ডেকোরশনে আইসিং বা ওপরে সাদা রঙের আস্তরণ থাকে।

গুঁড়ো চিনি, ডিমের সাদা অংশ আর ফ্লেভার ব্যবহার করা হত আইসিংয়ের ক্ষেত্রে। আইসিং ঠান্ডা হলেই শক্ত হয়ে যেত। সে সময় অনেক কেকেই ড্রাই ফ্রুটস ব্যবহারের চল ছিল। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে কেক তৈরিতে সাদা ময়দা আর বেকিং পাউডার ব্যবহার শুরু হয়। ফরাসি শেফ আন্তনিন কারেমকে আধুনিক কেক বেক তৈরির জনক বলে মানা হয়। ফরাসি ভাষায় কেককে বলা হয় গাতো (Gateaux) আর জার্মান ভাষায় কেককে বলা হয় টর্ট (Torte)। কেক তৈরির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় কেক ছিল লাক্সারি আইটেম। এসময়ই ফ্রুট কেক আর ক্রিসমাস কেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মধ্য যুগে চিনি ছিল দামি জিনিস। তাই কেকে মিষ্টত্ব আনতে মধু ব্যবহার করা হত। রেনেসাঁ আমলে কেক তৈরিতে চিনির ব্যবহার শুরু হয়। ১৭৬৪ সালে প্রথম চকোলেট কেক তৈরি করেন জেমস বেকার ও জন হ্যানন। প্রাচীন মিশরে কেক তৈরিতে সিমুইয়ের গুঁড়ো, মধু, মাখন আর ডিম ব্যবহার করা হত। প্রাচীন মিশরে দেব-দেবী আর ফারাওদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হত। স্কটল্যান্ডে কেক তৈরিতে হুইস্কি আর ব্র্যান্ডি ব্যবহার করা হত। বিয়ে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে কেক পরিবেশন করা হত। অরেঞ্জ কেকের জন্ম চিনে হলেও তা জনপ্রিয়তা লাভ করে জাপানে। এখন আমরা যে কেক খাই তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা প্রথম আমলের কেক। তা ছিল অনেকটা পাঁউরুটির মতো। মধু ব্যবহার করা হত মিষ্টি ভাব আনতে। মাঝেমধ্যে বাদাম আর ড্রাই ফ্রুটস ব্যবহার করা হত। প্রাচীন যুগে সাধারণত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কেক পরিবেশন করা হত। জীবনচক্র বোঝাতে কেক গোলাকার হত। আগেকার দিনে কেক হাতে তৈরি করা হত তাই কেকের আকার গোল হত।

Related Articles