সম্পাদকীয়

ট্রুডোর পদত্যাগ, মেজর পডালিমের ‘গৌরবগাথা’ প্রচার

Trudeau's resignation, Major Podalim's 'glory story' promoted

Truth Of Bengal: কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগ আর আচমকাই বাংলাদেশে বর্তমান অস্থির সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে মেজর ডালিমের ভেসে ওঠা, এই দুটো একই সময় ঘটছে। আমরা যদি দুটি ঘটনাকে এক সূত্রে জুড়তে নাও চাই, তাহলেও এটা সত্যি যে ট্রুডো তাঁদের আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন, যাঁরা ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে মদত দিচ্ছিল। অর্থাৎ নয়াদিল্লির পরিষ্কারই অভিযোগ ছিল যে টুডোর আমলে কানাডা আসলে খ ালিস্থানপন্থীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে।

কানাডায় খালিস্থানপন্থীদের এই দাপাদাপি অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। এর আগে অর্থাৎ গত শতকের ৮ এর দশকেও যখন জাস্টিন ট্রুডোর বাবা, পিয়ের ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে খ ালিস্থান পন্থীদের বাড়বাড়ন্তের বিষয় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় সেই সময়ও পিয়ের ট্রুডো যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেননি। এবং এয়ার ইন্ডিয়ার কনিষ্ক বিমানে বোমা বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল।

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কনিষ্কতে যারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ছিল, তারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী ছিল। ঠিক তেমনই বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেজর ডালিমও একজন জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদীই। দুঃখের বিষয় আজকের বাংলাদেশে একদল বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন শাসক গোষ্ঠী মেজর ডালিমকে গৌরবান্বিত করতে চাইছে। ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা বা তাঁর ভাষায় যিনি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’, যাঁকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ তাঁর অন্তর্বতীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রীপদেও নিযুক্ত করেছেন, সেই মাহফুজ আলম অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ১৯৭৫ এর মুজিব হত্যাকে ‘জাস্টিফাই’ করার বা যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মাহফুজ আলমের সেই পোস্ট নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তিনি অবশ্য আর সমাজ মাধ্যমে সেই পোস্টটি নিজের টাইমলাইনে রাখার সাহস দেখাতে পারেননি। মুছে ফেলেছেন।

কিন্তু মাহফুজ আলম থেকে স্বয়ং মহাম্মদ ইউনুস চেষ্টা করলেও ১৯৭৫ এর মুজিব হত্যাকে গৌরবান্বিত করতে পারবেন না। হত্যা বা খুন খুনই থাকে। সেটাকে ‘গ্লোরিফাই’ করা যায় না। ঠিক যেমন কানাডায় ট্রুডোর মদতে খালিস্থানপন্থীরা ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারীদের মূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বা তাঁদের গৌরবান্বিত করে তুলতে উদ্যোগী হলেও তা সফল হয়নি।

ভারতবর্ষে জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে গুলি চালিয়ে যিনি হত্যা করেছিলেন, সেই নাথুরাম বিনায়ক গডসেকে কেউ কেউ গৌরবান্বিত করবার চেষ্টা করলেও রাজনৈতিকভাবে তা সফল হয়নি। নাথুরাম বিনায়ক গডসে একজন খুনি হিসেবেই ভারতের ইতিহাসে থেকে গিয়েছেন। ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাটা মাহফুজ আলম বা মেজর ডালিমরা নেননি। এমনকি যে আমেরিকার ডেমোক্রাট দলের মদতে বাংলাদেশে ইউনূস সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং জামাতপন্থীদের বাড়বাড়ন্ত, সেই জামাতি মৌলবাদীরা যদি মন দিয়ে আমেরিকার ইতিহাসটা পড়তেন, তাহলে দেখতে পেতেন যে দাস প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে যিনি আমেরিকার গৃহযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকেই ইতিহাস মনে রেখেছে।

মার্কিন মুলকের সেই আইকনিক প্রেসিডেন্টকে আততায়ীকে ইতিহাস এবং সমাজ আজও খ নি বলেই মনে করে। তাই আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই ইউনুস নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হতে পারেন, মাহফুজ আলম তাঁর দক্ষিণ হস্ত হতে পারেন, আর এদের প্রশ্রয়ে মেজর ডালিম ক্যামেরার সামনে এসে যা ইচ্ছে বলতে পারেন, কিন্তু ডালিম সারা জীবনই মুজিবের খুনি থেকে যাবে। ইতিহাসে মেজর ডালিমের অন্য কোনও পরিচয় হবে না।

আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি, যাঁরা ভারত বিরোধিতা করতে চান, তাঁরা অনেক সময়ই অনেক শর্টকাট রাস্তা বাছেন। যেহেতু ভারতবর্ষে হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু, তাই হিন্দু মন্দির আক্রমণ করে তাঁরা মনে করেন নয়াদিল্লিকে শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে। এটা এক ধরনের ‘স্লেজিং’। সেটা রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষ বোঝে, নয়াদিল্লি আরো ভালো করে বোঝে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভারত বিরোধিতার উদাহরণ হিসেবে যদি হিন্দু সন্ন্যাসীকে জেলে ভরাটাই ‘প্রতীকী শিক্ষা’ দেওয়া বলে কেউ মনে করেন, মন্দির আক্রমণে কেউ উৎসাহ দেন, তাহলে তিনিও রাজনীতির ভুল পথে হাঁটছেন। কানাডাতেও ট্রুডোর জমানায় হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হয়েছিল বলে সেখানে বসবাসকারী হিন্দুরা অভিযোগ করেন। ভারতবর্ষ এই নিয়ে টুডো সরকারের কাছে বারবার অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই জাস্টিন ট্রুডো ভাববেন ভারত বিরোধিতায় মদত দিয়ে বা ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত শক্ত করতে গিয়ে আসলে তাঁর কোনও লাভ হল কি?

বাংলাদেশও মৌলবাদীদের গোল্লাছুট খেলতে দিয়ে মহম্মদ ইউনুসের কি লাভ হচ্ছে, সেটা তাঁরই ভাবা দরকার! দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে মৌলবাদ এমন মাথাচাড়া দিচ্ছে এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ নিজে ক্ষমতায় বসে থাকার জন্য সেই মৌলবাদীদের এতটাই প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যে শুধু সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন এমন নয়, উদারনৈতিক মুসলিমরাও প্রতিনিয়ত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। দরগা ভাঙ্গা হচ্ছে, মাজার আক্রান্ত হচ্ছে, সুফি গানের জলসায় তাণ্ডব চালানো হচ্ছে! আমেরিকার তথাকথিত যেসব লিবারেলদের আশীর্বাদে মহম্মদ ইউনুস ঢাকার সিংহাসনে বসেছেন, তাঁরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার এই মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশের অবস্থা, রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে কি বলবেন, সেইদিকে সকলে তাকিয়ে রয়েছে। ভুল বললাম। আসলে মার্কিন মুলুকেই ক্ষমতা হারানোর পর ডেমোক্রাটদের, হিলারি ক্লিন্টন কিংবা জো বাইডেনদের মতো নেতাদের হয়তো আর খুব একটা কিছু বলার নেই। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ শে জানুয়ারি হোয়াইট হাউজে বসে যাওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে কি ভাববেন সেটা অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।