সম্পাদকীয়

শিক্ষা বিস্তারে পাঠাগারের ভূমিকা সমান প্রাসঙ্গিক

The role of libraries in the spread of education is equally relevant

Truth Of Bengal: রাজু পারাল: একটা দেশ এবং জাতির মেরুদণ্ডই হচ্ছে শিক্ষা। যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যত বেশি উন্নত, সেই দেশের বা জাতির মেরুদণ্ড ততটাই শক্ত। মানুষের মনের বিচিত্র অনুভূতি এবং চিন্তা-ভাবনা লিপির সাহায্যে গ্রন্থে ধরে রাখা যায় এবং গ্রন্থের মাধ্যমে তা বহুজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কোনও মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে গ্রন্থের সাহায্যে যুগ যুগ ধরে রাখা যায়। মানুষের মৃত্যু ঘটে কিন্তু তার ভাব ও ভাবনা গ্রন্থের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকে। আর সেই গ্রন্থের পর গ্রন্থ সাজিয়েই তৈরি হয় পাঠাগার। তাই বলা চলে পাঠাগারই হল জ্ঞানভাণ্ডার।

মানুষের জ্ঞান তৃষ্ণা চরিতার্থ করে পাঠাগার। সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্যও পাঠাগার গুরুপ্তপূর্ণ। মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা ও সিদ্ধিলাভের জন্য অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। আর এই অধ্যবসায়ের বেশির ভাগটাই পূর্ণ করে একটি ‘গ্রন্থাগার’ বা ‘পাঠাগার’। জ্ঞান সমুদ্রে পাড়ি জমিয়ে জীবন সাধনার খ্যাতির শিখরে অবস্থান করেছেন যাঁরা, বলাবাহুল্য পাঠাগারকে তাঁরা প্রথম থেকেই গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। পাঠাগারকে অবলম্বন করেননি এমন গুণী মানুষের সংখ্যা সম্ভবত বিরল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম নন।

জ্ঞান জগতের প্রায় সব ক্ষেত্র নিয়েই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অল্পবিস্তর ভেবেছেন। সেই চিন্তার ফসল লেখনির কাঠামোয় বাঁধা পড়ে আজও প্রতিনিয়ত আমাদের সমৃদ্ধ করছে। কবিগুরু তাঁর ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘মহাসমুদ্রের শত বছরের কল্লোলকে যদি এমনভাবে বাঁধা রাখা যেত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’

জ্ঞানচর্চার বৃহৎ ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্বভারতীর মতো যায়গায় বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের বা গবেষণার জন্যে প্রচুর উৎকৃষ্ট মানের বই দরকার এবং আধার হিসেবে একটি উৎকৃষ্ট পাঠাগারের প্রয়োজন সে কথা কবিগুরু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। গ্রন্থাগারের গুরুত্বের কথা বুঝেই কবিগুরু বিশ্বভারতীকে আন্তর্জাতিক স্তরে ভাষা ও জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান রূপে গড়ে তুলেছিলেন।

এক সময় শিষ্যরা গুরুর কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করত। শিষ্য পরম্পরায় সেই জ্ঞান দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে প্রবাহিত হত। তারপর আবিষ্কার হল অক্ষরের। বহু ধাপ অতিক্রম করে রচিত হল কাগজের গ্রন্থ। গ্রন্থের পর গ্রন্থ সাজিয়ে তৈরি হল গ্রন্থাগারের। মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবার জন্য যুগে যুগে, দেশে দেশে স্থাপিত হল গ্রন্থাগার। যেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

অগাস্টাসের প্রচেষ্টায় রোমে সর্বপ্রথম সাধারণ পাঠাগার স্থাপিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও উল্লেখযোগ্য পাঠাগার স্থাপিত হয়েছিল। ভারত, মিশর, চিন, তিব্বত ইত্যাদি দেশের পাঠাগারগুলি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। আমাদের দেশে নালন্দা, বিক্রমশীলা, তক্ষশীলা, বারাণসী ইত্যাদির পাঠাগার ছিল বিখ্যাত। একালে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি, এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ লাইব্রেরি, প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগার, আমেরিকার ওয়াশিংটন লাইব্রেরি বিশ্ববিখ্যাত। উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে এভাবেই পৃথিবীর নানা স্থানে গড়ে উঠেছে নানারকমের গ্রন্থাগার।

জ্ঞান পিপাসু মানুষের একক প্রচেষ্টায় যেমন গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত পাঠাগার। তেমনই স্কুল ছাত্রদের প্রয়োজন মেটাতে গঠিত হয় স্কুল লাইব্রেরি। বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ুয়াদের সুবিধার জন্য গড়ে ওঠে অনুরূপ পাঠাগার। লাইব্রেরির গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রমথ চৌধুরি বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল।’

মানসিক সংকীর্ণতা দূর করা এবং জ্ঞান বিস্তারে পাঠাগারের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি এই উক্তি করেছিলেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, আইন, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, ভ্রমণ, জ্যোতিষ, কবিতা, জীবনী ইত্যাদি যে বিষয়েই মানুষের জ্ঞান তৃষ্ণা থাক না কেন, পাঠাগার দ্বারা প্রত্যেকই উপকৃত হয়। মানুষের বয়স যাই হোক, রুচি যেমনই হোক না কেন জ্ঞান-তৃষ্ণা মেটানোর কোনও বাধা থাকে না। স্কুল কলেজে পড়ার সময় সুযোগ সবার হয় না। আবার স্কুল কলেজের তালিকাভুক্ত বই পড়ে পড়ুয়াদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না, পাঠাগার সেই অভাব দূর করে।

কেবলমাত্র পাঠক তৈরিই পাঠাগারের কাজ নয়- রুচিশীল পাঠক তৈরিই আসল কথা। আধুনিক যুবসমাজে রুচিহীন অশ্লীল গ্রন্থপাঠের প্রতি অনেকের প্রবণতা দেখা যায়। সেই প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে পাঠাগারের দায়িত্ব অনেকখানি। পাঠাগারের সংগ্রহে এমন পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ থাকবে যা জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক হবে। কোনও পাঠাগারে শুধু গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদির বই থাকলেই চলবে না। রাখতে হবে ভ্রমণ, বিজ্ঞান, জীবনী, ধর্ম, দর্শন, চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ, ইতিহাস, চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের বই। পাঠাগারে কেবল নামি দামি লেখকের অসার বই নয়, প্রয়োজনে অনামী লেখকের উৎকৃষ্ট বইও রাখতে হবে। আবার শুধু সংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, বিষয় বৈচিত্র্যই হবে পাঠাগারের বই সংগ্রহের মুল লক্ষ্য।

আমাদের মতো দেশে যেখানে অশিক্ষা, কুশিক্ষা এত ব্যাপক সেখানে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে পাঠাগারের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেকথা স্মরণ রেখেই আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে। আমাদের এই রাজ্যেও সরকার পাঠাগার বিস্তারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কেবল পাঠাগারের সংখ্যাবৃদ্ধিই নয়, অনুদানের পরিমাণও বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিত্য নতুন বই কিনে পাঠাগারগুলিকে সুসজ্জিত করা হচ্ছে। সুষ্ঠ পরিচালনা এবং পুস্তক সংরক্ষণের জন্য গ্রন্থাগার বিজ্ঞান শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে।

পাঠাগারগুলি দেশ ও জাতির সম্পদ। তাই পাঠাগারের বিস্তার এবং সেগুলিকে সমৃদ্ধশালী করে তোলা একান্ত প্রয়োজন। বই পড়া শুধু শিক্ষার জন্য নয়, সৎসঙ্গের জন্য তা জরুরি। আধুনিক কালে যদিও কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের প্রসার ঘটার ফলে বই পড়ার চাহিদা কিছুটা কমেছে তবুও বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই। সময় কাটানোর জন্য, নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য এবং মানসিক আনন্দলাভের জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। বই না পড়লে মানুষ তার জীবনে একটা বড়ো আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়।

বই আমাদের এমন সঙ্গী যে ঠকায় না, বরং তার মধ্যে থেকে মানুষ সৃষ্টি করে নতুন নতুন উপকরণ, যা তাকে বাঁচবার রসদ জোগায়। বিশেষ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাছে বই পড়ার বিকল্প নেই বললেই চলে। বর্তমান সময়টা ডিজিটাল যুগের সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু যতই ডিজিটাল যুগের সুবিধা থাক না কেন, ছাপার অক্ষরে লেখা পড়তে এখনও মানুষ চায়। লেখা কখনও লুপ্ত হবে না, তা ডিজিটাল হোক বা ছাপার অক্ষরে। সব কিছু বিলুপ্ত হলেও মানুষের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের চর্চা সারাজীবন টিকে থাকবে। একটি সভ্য, সুশিক্ষিত, সংস্কৃতমনস্ক, মানবতাবাদী জাতি গঠন করতে হলে শিক্ষা অবশ্যই সবার আগে দরকার। আর এই শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজন আদর্শ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় দরকার একটি করে গ্রন্থাগার। মানুষের মধ্যে বই পড়ার উৎসাহ বাড়লে সেই সমাজে সুস্থ মানসিকতা, সংস্কৃতি এবং সুষ্ঠু ব্যবহারিক বিকাশের দিকগুলি ততটাই উন্নত থেকে উন্নততর হবে।

Related Articles