সম্পাদকীয়

‘SIR-এর কাছে স্যারদের নিবেদন…’

সবচেয়ে বড় বিষয় শিশু শিক্ষার সাথে নিযুক্ত প্রাথমিক ও উচ্চ প্রথমিক স্তরের শিক্ষক শিক্ষিকারাই এক্ষেত্রে বেশি নিযুক্ত হয়েছেন।

ড. রাম কৃষ্ণ সেন: ভারতের গণতন্ত্রে শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা বহন করছে। তাঁরা সমাজ গঠনের স্থপতি, নৈতিক মূল্যবোধের বাহক, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নির্মাতা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজ এক নতুন প্রশাসনিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ ভোটার তালিকা সংশোধন বা এসআইআর প্রক্রিয়ায় বিএলও হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। এ কাজকে প্রশাসন ‘নির্বাচন সম্পর্কিত দায়িত্ব’ বলে ব্যাখ্যা করলেও, বাস্তবে তা শিক্ষার স্বাভাবিক ধারাকে ভঙ্গ করছে এবং শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯ -এর একাধিক ধারা লঙ্ঘন করছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় শিশু শিক্ষার সাথে নিযুক্ত প্রাথমিক ও উচ্চ প্রথমিক স্তরের শিক্ষক শিক্ষিকারাই এক্ষেত্রে বেশি নিযুক্ত হয়েছেন। শিক্ষক যখন পাঠদান ছেড়ে মাঠে ভোটার তথ্য যাচাইয়ে ব্যস্ত, তখন বিদ্যালয়ে ঘণ্টা বেজে চলেছে কিন্তু শ্রেণিকক্ষ ফাঁকা। শিশুদের চোখে বিভ্রান্তি, পাঠক্রমে ভাঙন এবং শিক্ষার অধিকার হয়ে উঠছে কেবল কাগজের অক্ষর। ২৫ বছর পূর্বে তখনকার নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুযায়ী নিযুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকা নতুন করে টেট না দিলে শিক্ষার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে অথচ তাঁরা ক্লাসে না গেলে শিক্ষার অধিকার সুরক্ষিত থাকছে? অদ্ভুতুড়ে কান্ড!

বিএলও বা বুথ লেভেল অফিসার মূলত ভোটার তালিকা সংশোধন ও যাচাইয়ের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাঁরা প্রতিটি ভোটকেন্দ্র এলাকার অন্তর্ভুক্ত নাগরিকদের নাম, বয়স, ঠিকানা ও ভোটার যোগ্যতার তথ্য যাচাই করেন। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রতি বছর এই কাজ নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চলে। যেহেতু এই সময়টি শিক্ষাবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বার্ষিক মূল্যায়ন ও প্রস্তুতির সময় শিক্ষকরা যখন বিএলও ডিউটিতে মাঠে থাকেন, বিদ্যালয়ে কার্যত পাঠদানের ব্যাঘাত ঘটে। কমিশণ যুক্তি দেয় নির্বাচন সম্পর্কিত কাজ, তাই আইনত অনুমোদিত।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এটি কি প্রকৃত অর্থে ইলেকশন ডিউটি? যদি এটি নির্বাচনের প্রস্তুতি মাত্র হয়, তবে তা কি আরটিই অ্যাক্ট-এর ২৭ ধারায় বর্ণিত ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ে? উত্তর হল না। Right of Children to Free and Compulsory Education Act, 2009, যা সংক্ষেপে আরটিই অ্যাক্ট-২০০৯ নামে পরিচিত, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১এ-এর বাস্তবায়ন। এই আইনের মূল লক্ষ্য ছিল—৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতিটি শিশুকে অবাধ, বিনামূল্যে ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা।

এই আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা-
ধারা ২৭ (সেকশন ২৭ ) – যা স্পষ্টভাবে শিক্ষকের দায়িত্বের সীমা নির্ধারণ করে।
ধারা ২৭ (সেকশন ২৭ ) অনুযায়ী-
“No teacher shall be deployed for any non-educational purpose other than the decennial population census, disaster relief duties, or duties relating to elections to the local authority or State Legislatures or Parliament.”
অর্থাৎ, শিক্ষককে শিক্ষাবহির্ভূত কাজে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ বেআইনি, শুধুমাত্র তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া
১. জনগণনা (সেনসাস )
২. দুর্যোগ ত্রাণ (ডিজাস্টার রিলি)
৩. নির্বাচন কার্য (ইলেকশন ডিউটি) – যা বোঝায় ভোটগ্রহণ বা গণনা-সংক্রান্ত দায়িত্ব, ভোটার তালিকা সংশোধন নয়। সুতরাং, বিএলও ডিউটি এই ধারার আওতায় পড়ে না। এটি কোনো নির্বাচনী দিনে ভোট গ্রহণ বা গণনার দায়িত্ব নয়, বরং প্রশাসনিক প্রস্তুতির অংশ যা শিক্ষাবহির্ভূত এবং আইনবিরুদ্ধ।

ভারতের Representation of the People Act (1951) -এর ভাষায়, ইলেকশন বলতে বোঝানো হয়েছে ভোট গ্রহণ ও গণনার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, ভোটার তালিকা সংশোধন একটি প্রি-ইলেকশন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ প্রসেস। – যা নিৰ্বাচন কমিশনের প্রশাসনিক কর্তব্য, নির্বাচন কাৰ্য নয়। অতএব, বিএলও ডিউটি আরটিই অ্যাক্ট-এর ধারা ২৭ অনুযায়ী নন এডুকেশনাল ডিউটি হিসেবে গণ্য হবে। সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় বারবার বলেছে যে, শিক্ষকদের শিক্ষার বাইরে অন্য কাজে অতিরিক্তভাবে নিযুক্ত করা হলে তা শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

যেমন, Avinash Mehrotra vs Union of India (2009) মামলায় আদালত নির্দেশ দিয়েছিল—
“The State must ensure that teaching is not interrupted by administrative or non- academic assignments.”
এই রায় পরোক্ষভাবে বিএলও ডিউটির মতো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে। যে বিএলও ডিউটি ‘ইলেকশন রিলেটেড’ কিন্তু নির্বাচনের দিন বা গণনার সঙ্গে এর সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। অতএব, শিক্ষককে এই কাজে বাধ্য করা মানে আইন লঙ্ঘন করা।

কিন্তু বিএলও ডিউটির সময় শিক্ষকরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিদ্যালয় থেকে অনুপস্থিত থাকেন। ফলে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়, পাঠক্রম অসম্পূর্ণ থাকে। শিক্ষক অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দেয়, শিক্ষার অভ্যাস নষ্ট হয়। আরটিই-এর ৪ (১) ধারায় রাষ্ট্রের কর্তব্য ছিল মানসম্পন্ন শিক্ষা অব্যাহত রাখা, যা এখানে ব্যাহত হচ্ছে। একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র একজন বা দুইজন শিক্ষক থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ বিএলও ডিউটিতে গেলে বিদ্যালয় কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

এভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা স্টেটস নেগলিজেন্স হিসেবে গণ্য হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১এ অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার ‘ফান্ডামেন্টাল রাইট’। বিএলও ডিউটি সেই অধিকারকে সরাসরি ক্ষুণ্ণ করে, কারণ রাষ্ট্র নিজে শিক্ষকের অনুপস্থিতি ঘটাচ্ছে। রাজ্য প্রশাসন যখন শিক্ষকদের ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে পাঠায়, তখন তা শুধু আইনি নয়, নৈতিক দিক থেকেও গুরুতর প্রশ্ন তোলে।

শিক্ষক সমাজকে প্রশাসনিক যন্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে। শিক্ষা নয়, ভোটের পরিসংখ্যানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনকে নির্বাচনী খাতিরে উপেক্ষা করা হচ্ছে। শিক্ষার মান যেমন কমছে, তেমনি শিক্ষক সমাজের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। শিক্ষকদের বিএলও ডিউটিতে নিয়োগ শুধু শিক্ষার অধিকার নয়, তাঁদের শ্রম অধিকারকেও অগ্রাহ্য করছে। অনেক শিক্ষক ব্যক্তিগত সময়, উৎসবের দিন, এমনকি বিদ্যালয়ের কার্যদিবসেও মাঠে কাজ করতে বাধ্য হন। এই অবস্থায় শিক্ষক সমাজের একাংশ প্রশ্ন তুলেছে, আমরা কি শিক্ষক, না প্রশাসনিক ক্লার্ক?

বর্তমানের সমস্যা:
প্রতিটি স্কুলে পুজোর ছুটির পর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পরীক্ষা চলছে। অথচ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শিক্ষিকা নেই। এক্ষেত্রে কীভাবে মূল্যায়ন সম্পাদিত হবে? মাধ্যমিক পরীক্ষার টেষ্ট চলছে কিন্তু কোনো কোনো বিষয়ের বিষয় শিক্ষক-শিক্ষিকা এসআইআর-এর কাজের জন্য স্কুলে আসতে পারছেন না। খাতা দেখতে পারছেন না। এতে উত্তরপত্রের মূল্যায়ন যথাযথ হবেনা। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় ক্লাসে বিষয়ভিত্তিক পঠন পাঠন কার্যত বন্ধ। হয়তো একই বিষয়ে চারবার ক্লাস হচ্ছে। অন্য বিষয়টির কোনো ক্লাসই হচ্ছেনা বিষয় শিক্ষকের অভাবে।

বহু স্কুলে শিক্ষাকর্মীর অভাব থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বিএলও ডিউটিতে ডাকা হয়েছে। এর ফলে এই মূহুর্তে সবুজ সাথী, উচ্চ মাধ্যমিকের তৃতীয় সেমেষ্টারের ফলপ্রকাশ, দশম শ্রেণির মাধ্যমিকের ফর্ম ফিলআপ, কন্যাশ্রী, মাইনোরিটি স্কলারশিপ, জাতিগত স্কলারশিপ, ইউডিআইএসই সহ একগুচ্ছ কাজের চাপ অন্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিতে হচ্ছে। ফলে যারা বিদ্যালয়ে উপস্থিত আছেন তাঁরাও পড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। শিক্ষাকর্মীসহ এইসব প্রকল্পের নোডাল টিচাররাও যখন এসআইআর-এর কাজে যুক্ত হচ্ছেন তখন পোর্টাল নির্ভর এইসকল কাজ নতুন একজনের পক্ষে ক্লাসের পাশাপশি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা দুষ্কর হয়ে উঠছে।কারণ তাঁকে ওই সক্রান্ত সকল কাজ নতুন করে জেনে বুঝে তারপর সম্পাদন করতে হচ্ছে।

বিকল্প ব্যবস্থা ও সুপারিশ
ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শিক্ষাবহির্ভূত কর্মীদের দিয়েও করা সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মী, পঞ্চায়েত সদস্য বা স্বেচ্ছাসেবককে বিএলও হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। রাজ্য সরকার আরটিই অ্যাক্ট -এর ২৭ ধারা মেনে একটি প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি জারি করতে পারে যেখানে স্পষ্ট বলা থাকবে যে শিক্ষকরা শুধুমাত্র ভোট গ্রহণের কাজেই নিযুক্ত হবেন, এসআইআর বা বিএলও কাজে নয়। যদি কোনো কারণে শিক্ষককে ডিউটি করতে হয়, তবে বিদ্যালয়ে বিকল্প শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উচিত।

শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষাপ্রশাসনের মধ্যে আরটিই অ্যাক্ট ২০০৯-এর ধারা সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা নিজেরাই জানেন না যে তাঁরা আইনত এই ডিউটিতে বাধ্য নন। শিক্ষকদের বিএলও ডিউটি প্রদান কেবল প্রশাসনিক ত্রুটি নয়—এটি সংবিধান ও শিক্ষার অধিকার আইন উভয়ের লঙ্ঘন। যে আইনের মূল কথা ছিল, প্রতিটি শিশুকে মানসম্মত শিক্ষা, সেই আইনের ব্যাখ্যা ব্যবহার করে রাষ্ট্রই আজ শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত করছে।
যে শিশুর শিক্ষার সময় বিএলও-র ফর্ম পূরণে নষ্ট হয়, তার ভবিষ্যৎও ক্রমে ফিকে হয়ে যায়।

তাই বলাযায়—  শিক্ষকের বিএলও নয়, বোর্ডের প্রশ্নপত্রই তাঁর দায়িত্ব, বিদ্যালয়ই তাঁর অফিস, মাঠ নয়। আর শিশুর শিক্ষা ব্যাহত হলে, রাষ্ট্রই দায়ী। রাষ্ট্র যদি শিক্ষার অধিকার আইনের প্রতি সত্যিকার শ্রদ্ধা রাখে, তবে তাকে অবিলম্বে শিক্ষকদের বিএলও বা এসআইআর ডিউটি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এটাই আইনের দাবি, নীতির দাবি এবং শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার একমাত্র পথ।

Related Articles