সম্পাদকীয়

রবীন্দ্রনাথ: সংকটের কালে চেতনার দীপশিখা

Rabindranath: A beacon of consciousness in times of crisis

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— বাংলার ইতিহাস, সাহিত্যের গৌরব ও বিশ্ব-সংস্কৃতির এক অনন্য নাম। তিনি কেবলমাত্র একজন কবি, সাহিত্যিক কিংবা সঙ্গীতস্রষ্টা নন, বরং এক সর্বব্যাপী চেতনার ধারক, যিনি কালের সীমা অতিক্রম করে আজও মানুষের মননে, সমাজ-জীবনে, চিন্তাধারায় এক আলোকবর্তিকার মতো জ্বলে রয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই বিরল প্রতিভা, যিনি কবিতা, গান, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিত্রশিল্প, শিক্ষা, দর্শন, ধর্ম ও সমাজচিন্তা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই রেখেছেন অবিস্মরণীয় অবদান। মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা রচনার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করা রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য প্রথম এশীয় হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

কিন্তু তাঁর কর্মজীবন কেবল সাহিত্যসৃষ্টি বা সাংস্কৃতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না। শান্তিনিকেতন ও পরবর্তীতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষা দর্শনের এক অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন— যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা, মানবিকতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা ছিল শিক্ষার মূল ভিত। এই শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় পরীক্ষা নয়, বরং আত্মবিকাশ এবং হৃদয়বোধ ছিল মুখ্য।

জাতীয়তাবাদ বনাম মানবতাবাদে রবীন্দ্রচিন্তার দীপ্তি

রবীন্দ্রনাথের সময়ে ভারত ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। কিন্তু তিনি সেই সময়কার অন্ধ বর্ণবাদী বা প্রতিহিংসাপরায়ণ জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেননি। তিনি একাধারে ছিলেন স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার পক্ষে, অন্যদিকে সর্বজনীন মানবতার প্রবক্তা। ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন— যা ছিল এক ঐতিহাসিক সাহসিকতা এবং নৈতিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ।

তিনি লিখেছিলেন—

‘জাতীয়তাবাদ যদি মানুষের শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে, তবে সে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

এই বক্তব্য আজকের দিনে আরও প্রাসঙ্গিক, যেখানে জাতীয়তাবাদের নামে বিভেদ, ঘৃণা ও হিংসার বীজ বোনা হচ্ছে।

আজকের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ, সংকটের আলোকবর্তিকা। বর্তমান বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফাম– এর ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তির হাতে রয়েছে মোট বৈশ্বিক সম্পদের ৪৬ শতাংশ— যা অর্থনৈতিক বৈষম্যের চরম নিদর্শন। অন্যদিকে পরিবেশবিনাশ, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিচ্ছিন্নতা আমাদের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে ফেলছে। এই বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী চেতনা, সর্বধর্ম-সমন্বয়ের আহ্বান ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দর্শন আজও এক বিকল্প পথ দেখাতে সক্ষম। তিনি বলেছিলেন—

‘যা কিছু মূঢ়তা, সংকীর্ণতা, সংকট ও সংঘর্ষের জন্ম দেয়, তা থেকে মুক্তিই সত্য শিক্ষা।’

এই বাণী আজ যেন এক দার্শনিক নির্দেশ, এক অন্তর্দৃষ্টি।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা

রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ব্যাপারে বলেছিলেন— ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত হৃদয় ও মস্তিষ্কের সম্মিলিত জাগরণ।’

এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পরীক্ষাকেন্দ্রিক, মুখস্থনির্ভর ও রোবোটিক শিক্ষাব্যবস্থার সামনে এক জীবন্ত বিকল্প। তিনি পশ্চিমা সভ্যতার বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রাচ্যের আত্মিকতা— উভয়ের সমন্বয়ে এক বিশ্বমানব সভ্যতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘পূর্ব-পশ্চিম উভয় সভ্যতার যা শ্রেষ্ঠ, তাই গ্রহণ করতে হবে।’

এই দৃষ্টিভঙ্গিই আজকের জাতীয়তাবাদ বনাম বিশ্বায়নের বিতর্কে এক সমন্বয়বাদী সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে।

নারী ও প্রকৃতি এবং রবীন্দ্রদৃষ্টি

রবীন্দ্রনাথ নারীকে শুধুমাত্র মায়া-মমতার প্রতীক হিসেবে দেখেননি, তিনি নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সামাজিক আত্মমর্যাদার পক্ষে ছিলেন। ‘চণ্ডালিকা’, ‘নষ্টনীড়’, কিংবা ‘স্ত্রীর পত্র’-এর মতো রচনায় তিনি নারীর আত্মপ্রকাশ ও মুক্তিচেতনার প্রশ্ন তুলেছেন, যা আজকের নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রাসঙ্গিক।

এছাড়া, তাঁর প্রকৃতিপ্রীতি ও পরিবেশ সচেতনতা— যা তাঁর কবিতা, গানে এবং ব্যক্তিজীবনে অনুপমভাবে মূর্ত— তাও আমাদের বর্তমান পরিবেশ-সংকট মোকাবিলায় এক দার্শনিক ভিত্তি জোগাতে পারে।

বিশ্বমানবতা ও সহনশীলতার প্রয়াস

রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার উঠে এসেছে ‘বিশ্বমানবতার’ ভাবনা। ‘সভ্যতার সংকট’, ‘রাশিয়ার চিঠি’ প্রভৃতি প্রবন্ধে তিনি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সভ্যতার পাশবিক মুখোশ উন্মোচন করেন এবং একটি সহনশীল, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখান। তিনি বলতেন— ‘আমার মানবধর্মই আমার প্রধান পরিচয়।’

আজ যখন জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভাজন বাড়ছে, তখন এই একটি বাণী— সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এক উচ্চকিত প্রতিবাদ।

একলা চলার আহ্বান

রবীন্দ্রনাথ কেবলমাত্র স্মরণীয় এক সাহিত্যিক নন, তিনি এক অব্যর্থ মানবিক দর্শনের বাহক। তাঁর দর্শন, গান, কবিতা, প্রবন্ধ— সবকিছু আমাদের সংকটের কালে আত্মজিজ্ঞাসা ও প্রেরণার খোঁজে আশ্রয় হতে পারে।

আজ যখন ঘৃণা, স্বার্থ, ভয় ও বিভেদের কালো ছায়া আমাদের গ্রাস করছে, তখন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি এক চিরন্তন দীপশিখা। যদি আমরা ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে রাবীন্দ্রিক মূল্যবোধে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি, তবে এ পৃথিবী পরিণত হতে পারে এক নব শান্তিনিকেতনে— যেখানে থাকবে না হিংসা, বিভেদ। থাকবে কেবল মৈত্রী, মানবতা ও প্রেমের অপার আলিঙ্গন। তিনি নিজেই বলে গিয়েছেন— ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’

এই একলা পথচলাতেই আজ আমাদের নবজন্ম, নবপ্রত্যয়।

Related Articles